ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাজপথে রাজীবের খণ্ডিত হাত

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৫, ৭ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজপথে রাজীবের খণ্ডিত হাত

জাফর সোহেল : রাজীব এক তরুণের নাম। তার দুটি হাত ছিল। এখন আছে একটি। অন্য হাতটি পড়ে গেছে বাংলাদেশের রাজপথে। পড়ে যাওয়া সেই হাত রাজপথে গড়াগড়ি খেয়েছে অনেকক্ষণ। নগরীর লোকেরা যখন হাতটি কুড়িয়ে আনে ততক্ষণে কাটা হাতের স্পন্দন থেমে গেছে চিরতরে। এরপরের ঘটনা মিডিয়ার কল্যাণে অনেকেই জানেন। রাজীবের হাত আর জোড়া লাগেনি।

এটা গল্প নয়, সিনেমার কোনো দৃশ্যও নয়, বাস্তব ঘটনা। আপাতত রাজীব এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আপনজন আর সহপাঠীরা এখন তার দেখভাল করছেন। তাঁরা বলছেন, জ্ঞান ফেরার পর রাজীব তার হারিয়ে যাওয়া হাত খুঁজেছেন আরেক হাত দিয়ে। সময় যত গড়ায়, রাজীবের চৈতন্যে ধরা পড়ে- তার একটি হাত এখন আর নেই! সহপাঠীদের কাছ থেকে এখন মানুষ জানছে রাজীবের আরো আরো গল্প। সেসব গল্পের পরতে পরতে আছে একটি শব্দ- সংগ্রাম।

জীবনটা রাজীবের সংগ্রাম করেই কেটেছে। বাবা-মা হারা সবারই জীবনে আছে এমন সংগ্রামের গল্প। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব এই সংগ্রামে প্রায় জয়ী হয়ে উঠছিলেন কেবল। যাচ্ছিলেন স্বপ্নের কাছাকাছি। রাজীবের পরে আছে আরো দুই ছোট ভাই। নিজের পাশাপাশি তাই চিন্তা করতে হয় তাদের জন্যেও। খালা তাকে খাওয়া-পরা দিলেও কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল রাজীবের। সে টিউশনি করে। এটা-সেটা আরও কিছু আয়ের উপায় খোঁজে। খালা বলেন, রাজীবের কখনো উচ্চাশা ছিল না। সে খুবই সাদাসিধে চলাফেরা করত। যা দিত তাই খেত, পরত। স্বপ্নও তার বেশি কিছু ছিল না। মাস্টার্স পাস করবে, একটা চাকরি নেবে, একটা হয়ত লাল-নীল পরি খুঁজে নিয়ে ঘর শুরু করবে- এই তো! নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালির এর চেয়ে বেশি কিছু স্বপ্ন না থাকাই শ্রেয়! কিন্তু এই সামান্য স্বপ্নটুকুও আজ তার জীবনে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

এদেশের রাজপথে এভাবেই ছিটকে পড়া হাতের সঙ্গে ছিটকে পড়ে রাজীবদের ছোট ছোট স্বপ্ন। দুটি বাসের ঘষা খাওয়ার নেশা এই রাষ্ট্রে একরকম বৈধতা পেয়ে গেছে! একটা বাসের সঙ্গে আরেকটা বাসের গতির প্রতিযোগিতা রাজপথের স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দেয় না। এমনকি একজনের সামনে আরেকজন পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাসের ভেতরে মানুষ আছে নাকি পণ্য- ধর্তব্যের মধ্যে আনে না চালক, সহকারী কেউ। নগর পরিচালকেরা এসব দেখেও দেখে না। মাঝে মধ্যে অবশ্য আওয়াজ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অসারের তর্জন, গর্জন ওই পর্যন্তই।

চালক, সহকারীর নেতারা ঠিক তার উল্টো। তারা শক্তিমান। তারা এসব আইনের তোয়াক্কা করে না। প্রয়োজনে হুমকি দেয়। গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। মানুষ বিপদে পড়ে। তারা মুচকি মুচকি হাসে। নগর-চালকেরা উদ্ধার পেতে তাদের অন্যায় আবদারের কাছে নতজানু হয়। সরকার বিষয়টা একটা সুরাহার ভঙ্গিতে দায়িত্ব সারে। অতএব এই রাষ্ট্রে রাজীবেরা হাত খোয়াবে, এ আর বিশেষ কী? রাজীব হাসপাতালে কাতরাতে কাতরাতেই পত্রিকা রিপোর্ট করল- রাজপথের আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। সেখানেও বেপরোয়া গতি আর বাস চালকদের রেষারেষি। নিউমার্কেটের সামনে বিকাশ পরিবহনের একই কোম্পানির একই রুটের দুটি বাস প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। বাস দুটির  মাঝখানে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায় আয়েশা বেগম। সকালে বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বেরিয়েছিলেন এই মা। কপাল জোরে বাচ্চার কিছু হয়নি। কিন্তু আয়েশা বেগমের অর্ধেক দেহ নিস্তেজ হয়ে গেছে। ডাক্তার বলছে, এই নিস্তেজ হওয়া হয়ত সারা জীবনের জন্য।

আয়েশা আর রাজীবদের মতো দুর্ভাগ্য নিশ্চিতভাবেই অপেক্ষা করছে পথচলতি অনেক মানুষের জন্য। যে কোন সময় আমরা যে কেউ হতে পারি এমন ঘটনার শিকার। কারণ, পথের মধ্যে গতিদানবেরা নিত্য চালিয়ে যাচ্ছে গতির প্রতিযোগিতা। কারও কোন বিকার নেই এসব ঘটনায়। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রও দেখবে না সড়কে কী হয়, রাজপথে কী হয়। সে দেখবে না চালকের স্টিয়ারিং নিয়ে বসে আছে কে- পূর্ণ বয়স্ক কেউ নাকি নাবালক। সে দেখবে না রাস্তায় বেরুনো গাড়ির ফিটনেস আছে কিনা। শহরের শতকরা ৯০টি বাসের গায়ে ঘষা খাওয়ার দাগ কেন- এই প্রশ্নও রাষ্ট্র করবে না। চালক মুঠোফোনে কথা বলছে কি না, আরেকটি বাসের সঙ্গে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে চলছে কি না- এসবও দেখবে না সে। চালকদের হাতে প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট আছে কি নেই, তাতেও এই রাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না; তারা কেবল রাস্তায় গরু ছাগল চরে কি না তা দেখতে পেলেই হলো! রাষ্ট্রের মন্ত্রী একদিন এ কথা বলেছিলেন। আমরা শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। সুতরাং, রাজীবের হাত যাবে, আয়েশার কোমর যাবে, আমাদের প্রাণ যাবে, যেতেই থাকবে। কিচ্ছু করার নেই। সত্যিই কি কিচ্ছু করার নেই?

লেখক : সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়