ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাষ্ট্র উন্নয়নে শিল্পচর্চা কেন জরুরি?

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাষ্ট্র উন্নয়নে শিল্পচর্চা কেন জরুরি?

স্প্রিংস বার্থ-২. শিল্পী : মোখলেসুর রহমান

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: আমরা কি কেবলই মানুষ? শত শত বছর ধরে দার্শনিকরা এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন। মানুষ কেবল ‘মানুষ’ নয় বলেই তার দায়বদ্ধতা রয়েছে। রয়েছে সুন্দরের পথে চলার তীব্র স্পৃহা। কিন্তু তবুও আমরা সবাই কি মানুষ? উত্তর আমাদের জানা। বহুবিধ কারণে সব মানুষই মানুষ নয়। জীবনানন্দ দাশের কথাটি একটু ঘুরিয়ে বললে বলা যায়- সবাই মানুষ নয়, কেউ কেউ মানুষ। ২০১৭ সালে এসে যখন পত্রিকায় পড়তে হয় ৪ বছরের শিশু ধর্ষিত হয়েছে, যখন পড়তে হয় ১০ টাকার জন্যে খুন কিংবা গুজবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গৃহে আগুনের খবর, তখন মানুষ হওয়ার প্রশ্নটি আরো তীব্র হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, সত্যিই সভ্যতা এত দূর এগিয়ে গেলেও আমরা মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।

মানুষ ও সভ্যতার সাথে শিল্পচর্চার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, শিল্পমনস্ক মানুষ অন্যায় করে না, অন্যায়ের সঙ্গীও হয় না। বরং সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ সবসময় বলিষ্ঠ থাকে। শিল্পমনা মানুষই অন্যকে ভালো কাজের প্রতি উৎসাহী করতে পারেন। শিল্পীরা হৃদয়ের কথা বলেন বলেই তাদের সমাজচেতনা ও বোধ সজাগ থাকে। সকল কুসংস্কার ও কুপমণ্ডুকতা শিল্পীরা নির্দ্বিধায় মাড়িয়ে যান। হীনতা ও দীনতা দূরে সরিয়ে শিল্পী সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যান। শিল্পীর দায়িত্বের কাছে মৃত্যুও অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ হয়ে যায়। পৃথিবীতে এমন অনেক শিল্পী ছিলেন যারা অন্যায়ের সাথে আপোস করার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় বলে জেনেছিলেন। এ প্রসঙ্গে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে শুরু হওয়া ডাডাইজম আন্দোলনের শিল্পীদের কথা উল্লেখ করা যায়। এ আন্দোলনের উৎসমূলে ছিলো সভ্যতার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা, মানুষের অমানবিকতা ও নৃসংশতা। এ ধারার শিল্পীগোষ্ঠী মনে করতেন, প্রচলিত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে। যার কারণেই এই যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি। ডাডাবাদী শিল্পীরা শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রবলভাবে এ ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে হিটলার এ ঘরানার অনেক শিল্পীকে ‘বিকৃতি’র অভিযোগে হত্যা করেন। শুধু ডাডাবাদ নয়, পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, অন্যায়, অবিচার, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত বৃহৎ আন্দোলন হয়েছে তার অগ্রভাগে শিল্পীরাই ছিলেন।

একই সাথে এটাও স্মরণ রাখা জরুরি- আজকের সভ্যতা যতটা উন্নতি ও উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে গেছে তার পেছনে চিন্তাশীল মানুষের অবদান বেশি। হাজার হাজার বছর ধরে লাখ লাখ মানুষ পরিশ্রম করলেও সভ্যতার যে পরিমাণ উৎকর্ষ সাধন হতো না, একটি মহৎ চিন্তা অতি সহজেই সে উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। প্রাচীন সভ্যতার দিকে তাকালেও ‘চিন্তার শক্তি’ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। প্রাচীন গ্রিসের দিকে দৃষ্টি দিলে যে কজন ব্যক্তির নাম মুহূর্তেই সশ্রদ্ধভাবে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে তার মধ্যে সক্রেটিস প্রধানতম। সে সময়ের কোনো দোকানদার অথবা কৃষক অথবা চিকিৎসক অথবা খেলোয়াড়- কারো নাম কি আমরা জানি?  মহাকালের কঠিন বিচারে সভ্যতা কেবলমাত্র কৃতী, কর্মবীর, চিন্তাশীল মানুষকেই মনে রাখে। সেকারণেই সক্রেটিস এখনো বহুল আলোচিত এবং আলোকিত; অন্যরা নয়। শিল্পের চর্চার জগৎ চিন্তার জগৎ। এ চিন্তাশীল মানুষরাই রাষ্ট্র-উন্নয়নে অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক অবক্ষয়ের কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এ অবক্ষয় এতই স্পষ্ট যে, সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছানোর দৃশ্যটি সচেতন ব্যক্তি মাত্রই দেখতে পাবেন। এই নিম্নগামিতার প্রভাব আমাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনে পড়ছে। অবক্ষয়ের যে রকমফের রয়েছে, ছোটবড় রয়েছে, নির্মমতা ও নৃসংশতা রয়েছে- তার মধ্য দিয়েই আমাদের প্রতিনিয়ত যেতে হচ্ছে। প্রতিদিনের শিশু ধর্ষণ, হানাহানি, খুন, চোরাচালান, মাদক,  ঘুষ, দখলদারিত্বের কবলে পড়ে ‘মানুষ’ শব্দটি থেকে মানবিকতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। উল্টো দিন যতই যাচ্ছে মানবিক হওয়ার পরিবর্তে মানুষ ততই দানবে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিন মানুষের এই হিংস্র, নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড কেবল সুন্দর ও শুভ চেতনা এবং জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহই বিনষ্ট করে না, এমন কর্মকাণ্ড সভ্যতাকেও ভয়াবহ হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। নিঃসন্দেহে এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন।

এই সামাজিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণ পেতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফলপ্রসু উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। অন্যদিকে ব্যক্তি উদ্যোগ ও সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক অবক্ষয়ের জন্যে মানসিক অবস্থাই প্রধানত দায়ী। সমাজের এক শ্রেণির মানুষের মানসিক অবস্থা চূড়ান্ত বিকৃতির পর্যায়ে না পৌঁছালে নিত্যদিন এত নির্মম ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হতো না। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্যে প্রজন্মকে শিল্পমনস্ক করার কোনো বিকল্প নেই। কেননা, শিল্পই পারে মানুষের সৌন্দর্য ও সত্যবোধের চোখ খুলে দিতে। শিল্পের স্পর্শই পারে মানবিক মানুষকে আরো বেশি মানবিক, চিন্তাশীল ও উৎকৃষ্ট মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। শিল্পী মাত্রই ভালো ও মন্দের তফাৎ, পরিণাম ও পরিণতি উপলব্ধি করতে পারেন। শিল্পের কাজ যেহেতু মন রাঙানো, সুন্দরের দিকে মনকে ধাবিত করা- তাই শিল্পচর্চায় জড়িত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক কাজ থেকে দূরে থাকেন। শিল্পচর্চার সবচেয়ে বড় লাভটি হলো এতে শিল্পী নিজে তার প্রতিভাকে প্রকাশ করে যেমন আনন্দিত হতে পারেন, তেমনি অন্যরাও শিল্পীর সৃষ্টি দেখে সমৃদ্ধ হতে পারেন। শিল্পীর মননের আলোয় তারাও উদ্ভাসিত হতে পারেন। শিল্প চর্চায় নিঃসন্দেহে মানসিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাই মানুষকে শিল্পচর্চায় উদ্বুদ্ধ করলে সমাজ থেকে অনাচার, অবক্ষয়, অমানবিকতা দূর হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রও সমৃদ্ধ হবে। আমরা এমন অনেক শিল্পীর দেখা পেয়েছি যারা দেশকে বৈশ্বিকভাবে আলোকিত করেছেন। প্রত্যেক মহান শিল্পীই বহির্বিশে তাদের দেশ ও মানুষের নাম উজ্জ্বল করেছেন। তারা হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর সন্তান। শিল্পচর্চার কারণেই প্যারিস এত বিখ্যাত শহর। শিল্পচর্চার শক্তিই মানুষকে ভিন্ন দৃষ্টি নিয়ে প্যারিসকে দেখতে বাধ্য করেছে।

পরিশেষে বলি, মানুষ সৃষ্টিশীল প্রাণী। সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করে। কেবল বাংলাদেশ নয়, সকল রাষ্ট্রের সকল মানুষের উচিত তার প্রতিভা ও চিন্তাশক্তি কাজে লাগানো। আমরা মনে করি, প্রতিটি মানুষেরই শিল্পের সাথে থাকা প্রয়োজন। সেটা চিত্রকলা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য-যাই হোক না কেন। ‘শিল্পের সাথে থাকা’ বলতে যে মানুষকে ‘শিল্প সৃষ্টির’ সঙ্গে থাকতে হবে তেমন নয়। প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে হোক প্রতিটি মানুষের শিল্পের সংস্পর্শে থাকা জরুরি। কেননা কেবল শিল্পীই নন, শিল্পের সমঝদার মানুষও অবক্ষয়মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : গল্পকার ও সম্পাদক, বাঁক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়