ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শখের হাঁড়ি নিয়ে সুশান্ত পালের লড়াই

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১০, ২৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শখের হাঁড়ি নিয়ে সুশান্ত পালের লড়াই

সুশান্ত পাল

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : এক সময় ঘর-বাড়ি ইট পাথরের দালান ছিল না, ঘর তৈরি হতো মাটি দিয়ে, নয়তো গাছ দিয়ে।

আগের দিনে গ্রামের ঘরে ঝুলানো নকশি পাটের সিকায় হাঁড়ি শোভা পেত। ঘরের চার পাশে পাটের দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হতো অসংখ্য শখের হাড়ি। তখন ঘরে দামি শোকেস কিংবা আলমারি ছিল না, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সামগ্রী রাখা হতো শখের হাঁড়িতে।

এছাড়া আগের দিনে রসগোল্লা, চমচম, পিঠাপুলি বেয়াই বাড়িতে পাঠানোর প্রচলন ছিল। আর এগুলো বহন করা হতো হাঁড়িতে। সময়ের বিবর্তনে শখের হাঁড়ি এখন বিলুপ্ত প্রায়।

১৮ মে, আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে সপ্তাহ ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি তৈরি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ঢাকাস্থ জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘরে দেখা হয় শখের হাঁড়ির কারুশিল্পি সুশান্ত পালের সঙ্গে।

 


মৃতপ্রায় এ মৃৎশিল্প তৈরি করে আজও জীবিকা নির্বাহ করছেন রাজশাহীর কারুশিল্পী সুশান্ত পাল (৫৭)। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মৃৎশিল্প আকঁড়ে ধরে বেঁচে আছেন সুশান্ত পালের পরিবার। সুশান্ত পালের স্ত্রী মমতা রানী পাল, দুই ছেলে সঞ্জয় কুমার পাল ও মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল, এক মেয়ে সুচিত্রা রানী পাল এবং দুই ছেলের স্ত্রী মুক্তি রানী পাল ও করুণা রানী পাল সবাই এখন কারুশিল্পী।

আধুনিক প্লাস্টিক, সিরামিক, সিন্থেটিক, ধাতব, কাচ এবং মেলামাইন সামগ্রীর প্রচলনের কারণে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা ফুরিয়ে গেছে বহু আগে। তবুও মৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই করে যাচ্ছেন সুশান্ত পাল ও তার পরিবার। সুশান্ত পালের এ সংগ্রাম তাকে এনে দিয়েছে সম্মান। একাধিকবার দেশের সেরা কারুশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১৩ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হয়ে গেছেন জাপানে। জাপানি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে তার ছবি। শুধু তা-ই নয়, পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইতেও রয়েছে সুশান্ত পালের ছবি।

তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কারুশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদ, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, কারিকা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনসহ (বিসিক) সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৩০টি সনদ রয়েছে তার। ২০১১ সালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসেবে তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করে। পুরস্কারের সঙ্গে নগদ ৩০ হাজার টাকাও দেওয়া হয়। বিসিক নকশা কেন্দ্রের ‘আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকা’ জাতীয় মৃৎশিল্প প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগী হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন। এর আগে তিনি দুইবার বিসিকের শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী নির্বাচিত হয়েছেন। গত বছরও বিসিক তাকে শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী নির্বাচিত করেছে।

 


১৮ মে থেকে সুশান্ত পাল জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শন করছেন শখের হাঁড়ি-সাজি, পঞ্চসাজি, চুকোই, মাটির পুতুল, ঘোড়াসহ নানা রকমের দৃষ্টিনন্দন মাটির তৈজসপত্র। এগুলো ন্যূনতম ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। ১০ টাকায় বিক্রি হয় চুকোই। আর ৬০০ টাকায় বিক্রি হয় বড় শখের হাঁড়ি।

সুশান্ত পাল রাইজিংবিডিকে জানান, শখের হাঁড়ি তৈরি করা শিখেছেন দাদার কাছে। ছোটবেলা থেকে শখের হাঁড়ি তৈরি করতে গিয়ে সুশান্ত পালের কোমর ও ঘাড়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের চাহিদা তেমন একটা নেই। পরিবারের আদি পেশা শখের হাঁড়ি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।

বাঙালির জীবনসম্পৃক্ত আদি বিবিধ শৌখিন শিল্পোপকরণের মধ্যে ছিল শখের হাঁড়ি অন্যতম। এর রং, নকশা, মোটিফ এবং স্টাইলের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় চিরায়ত বাঙালি মানসের হারিয়ে যাওয়া আদিমতম ইতিহাসের স্মারক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়