ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শতাধিক শিশুর দ্বীপে কোনো পাঠশালা নেই

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩০, ২৬ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শতাধিক শিশুর দ্বীপে কোনো পাঠশালা নেই

জুনাইদ আল হাবিব : খেয়াঘাটের মাঝি আবু হোসেন। চেনা নাম আবু মাঝি। বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। দ্বীপ রমনী মোহনের চর শামছুদ্দিনে বাসিন্দা।

আবু মাঝির সন্তান মুরাদ, ফরহাদ, মিতু ও মিশু। আবু মাঝি দ্বীপের বাসিন্দা হলেও দ্বীপেই আটকে থাকেন না। মূল ভূ-খন্ডের মানুষের আচার-আচারণ, রীতি-নীতি অনেকটা কাছ থেকেই দেখেন। সেখানে শিশু-কিশোরদের যে দল দেখেন, তাদের কাঁধে থাকে পাঠশালার ব্যাগ। কখনও পাঠাশালায় যেতে দেখেন, কখনও-বা ফিরতে দেখেন। এ দেখাদেখি আবু মাঝির ভেতরের মানুষটা আবু মাঝিকে নাড়া দেয়। আবু মাঝি বড় ছেলে মুরাদকে পড়তে দেন দ্বীপ থেকে মূল ভূ-খন্ডের স্কুলে। মুরাদের পড়া থামে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে এসে। আবু মাঝির খরচে কুলায় না। মুরাদের আর স্কুল ফেরা হয়নি। শুধু মুরাদকে পাঠশালায় দেননি। ওর ছোট ফাহাদ এখন পড়ছে হেফজখানায়। মিতুকে দিয়েছেন প্রাইমারিতে। সে দ্বীপ থেকে খেয়াতে করে নিয়মিত স্কুলে যায়। এবার মিতু তৃতীয় শ্রেণিতে। মিতুর ছোট মিশু এখনও ছোট।

দ্বীপে ২৫টি পরিবারের শতাধিক শিশুর জন্য একটি পাঠশালাও নেই। দ্বীপে পাঠশালা না থাকলেও আবু মাঝির অদম্য ইচ্ছাশক্তিই বলে, দ্বীপের অভিভাবকরা চান তাদের শিশুরাও স্কুলে পড়ুক।

মেঘনার বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ রমনী মোহনের চর শামছুদ্দিন। ভৌগলিক অবস্থানে এটি উপকূলের বিপন্ন জনপদ লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর কালকিনিতে। দ্বীপ রমনী মোহনের চর শামছুদ্দিন অংশই কমলনগরের একমাত্র দ্বীপ। অবশ্য কমলনগরের মেঘনার সীমানায় সম্প্রতি কয়েকটি ডুবোচর জেগে ওঠেছে। এগুলো এখনও মানুষের বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। এ নাব্যতা সংকটেও মাঝে মাঝে লক্ষ্মীপুর-ভোলা এ রুটে ফেরি চলাচলেরও বিঘ্নতা সৃষ্টি হয়।

দ্বীপের শিশু রিকতার, সোহাগ, রিয়াজ। রিকতারের বয়স ১৩, সোহাগের ১২, রিয়াজের ৮। ওরা কখনও স্কুলের বারান্দায় পা রাখেনি। শুনেছে, পড়াশোনা করলে মানুষ বড় হয়! কিন্তু ওরা বড় হবে কি?

ওদের তিনজনকেই একসঙ্গে পাওয়া গেল এবং সবার অভিযোগটা এমন, ‘আঁঙ্গো চরে কোনো ইশকুল নাই। কেমনে হড়মু? ওই হাড়ে ইশকুল আছে। আমরাতো ঠিকমতো যাইতে হারিনা। খেয়াতো আর ব্যাক টাইমে থা না। একজনের ভাড়া পঞ্চাশ টিয়া। হত্যেক দিন এ টিয়া দিবো কে আঁঙ্গোরে? ঠিকঠাক মতো ভাত খাইতে হারি না। আবার স্কুলে হড়মু ওই হাড়ে গিয়ে?’

ওদের মাঝ থেকে রিকতার বলে উঠলো, ‘চরে এক মহিলা কোরআন শরিফ হড়াইতে হারে। হিয়ানে কোগা হড়ে। ওই রকম কোনো বড় ঘরও নাই যে সবাই পড়বে।’



রিকতার, সোহাগ, রিয়াজ। ওদের সবার কাজ মাছ কুড়ানো। এ মাছ কুড়ানোটাই যেন ওদের জীবিকা। মাছ কুড়িয়ে পেলে ওরা খেয়াতে করে চলে আসে মূল ভূ-খন্ডের মতিরহাট ইলিশ ঘাটে। ইলিশ ছাড়াও এখানে নানা প্রজাতির মাছ মিলে। তাই ওরা মাছ কিনবে। পাশাপাশি দু’মুঠো ভাত পেটভরে খেতে প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, তরকারি সব কিনে আবার খেয়াতে করে নদী পার হয়ে বাড়ি ফিরে। এভাবেই ওদের প্রতিদিন কাটে। ওরা জলোচ্ছ্বাসে ভাসে, ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। জীবনের অনেক সংকটময় পরিস্থিতির মুখেই ওদের জীবনের গতি বয়ে চলে।

পাঠশালা না থাকায় সংকটের কথা জানালেন ওদের অভিভাবক বেলাল মাঝি (৪২), আবু মাঝি (৬০), আলা উদ্দিন মাঝি (৪২)। তারা বলেন, ‘চরে একশ’র বেশি পোলাইন আছে। দুই আড়াইশ’ লোক। এদের ভিতরে খুব কম লোকেই অক্ষর-জ্ঞান জানে। জরিপ বা অন্য কোনো কারণে টিপসই দিয়ে সিগনেচার সারে। এ পরিস্থিতি সব ঘরে। এখানে কোনো স্কুলও নেই যে আঁঙ্গো পোলাইন-সাবাইনকে যে একটু পড়ামু।’

‘বর্ষাকালে জোয়ার আসলে নদীর পানি বেশি থাকে। সে সময় কেউতো আর ওই পাড়ে গিয়ে পড়তে পারবে না। শুকনা মৌসুম ছাড়া সব সময় খেয়া থাকে না। আঁঙ্গো ছেলে-সন্তানকে আমরা পড়াইতে চাই। এজন্য সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাই একটা স্কুলের।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়