ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১৮ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন

রুহুল আমিন : পদার্থ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মেধার তুলনায় তার চেহারা ছিল নিতান্তই সাদামাটা। একবার এক সুন্দরী অভিনেত্রী তাকে প্রস্তাব দেন, ‘চলুন আমরা বিয়ে করে ফেলি। তাহলে আমাদের সন্তানের চেহারা হবে আমার মতো সুন্দর আর মেধা হবে আপনার মতো প্রখর।’

আইনস্টাইনের নির্বিকার উত্তর, ‘কিন্তু যদি ঠিক এর উল্টোটা ঘটে, তবে কী হবে?’

আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে মারা যান। এই দিনে বিশ্ব বিখ্যাত এই বিজ্ঞানীর প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আইনস্টাইন ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির উরটেমবার্গে জন্মগ্রহণ করেন। আইনস্টাইনের বাবা-মা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মধ্যবিত্ত ইহুদি। বাবা হেরমান আইনস্টাইন মূলত পাখির পালকের বেড তৈরি ও বাজারজাত করতেন।

পাঁচ বছর বয়সে একটি কম্পাস হাতে পান এবং তার ব্যবহার দেখে বিস্মিত হন আইনস্টাইন। অদৃশ্য শক্তির কারণে কীভাবে কম্পাসের কাঁটা দিক পরিবর্তন করছে ? তখন থেকে আজীবন অদৃশ্য শক্তির প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এরপর ১২ বছর বয়সে তিনি জ্যামিতির একটি বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। আসলে বইটি ছিল ইউক্লিডের এলিমেন্টস।

তার প্রথম স্কুল ছিল ক্যাথলিক এলিমেন্টারি স্কুল। বাকপটুতা না থাকলেও তিনি এলিমেন্টারি স্কুলের সেরা মেধাবী ছাত্র ছিলেন।

আইনস্টাইনের উপর মাক্স টালমুড নামে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক ছাত্রের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। তাদের বাসায় মাঝে মাঝেই সে নিমন্ত্রণ খেতে যেতো। এভাবে এক সময় আইনস্টাইনের অঘোষিত প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় টালমুড। পরে টালমুডই তাকে উচ্চতর গণিত ও দর্শন বিষয়ে দীক্ষা দিতেন। স্কুল পর্যায়ে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি আয়ত্ত করার পর তিনি ক্যালকুলাসের প্রতি মনোযোগী হন।

ব্যবসায় ক্ষতি হলে তার বাবা সপরিবারে ইতালির মিলানে পাড়ি জমান। কিন্তু আইনস্টাইন রয়ে যান মিউনিখে। আইনস্টাইন  ১৫ বছর বয়সেই প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেন, যার নাম "চৌম্বক ক্ষেত্রে ইথারের অবস্থা সংক্রান্ত অনুসন্ধান" (The Investigation of the State of Aether in Magnetic Fields)।

বাবা তাকে মিউনিখের একটি বোর্ডিং হাউজে রেখে গিয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করার জন্য। একা একা তার জীবন দুঃসহ হয়ে উঠে। একে স্কুলের একঘেয়ে পড়াশোনা, তার উপর ১৬ বছর বয়স হয়ে যাওয়ায় সামরিক দায়িত্ব পালনের চাপ তাকে হাঁপিয়ে তোলে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাত্র ৬ মাস পরেই তাই মিউনিখ ছেড়ে বাবা-মার কাছে চলে যান। ইতালিতে তাকে কোনো স্কুলে ভর্তি করাননি তারা। তাই মুক্ত জীবন কাটাতে থাকেন আইনস্টাইন।

পরে তিনি সুইজারল্যান্ডের আরাইতে জস্ট উইন্টেলার পরিচালিত একটি বিশেষ ধরনের স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক হন। এখানে তিনি মূলত ম্যাক্সওয়েলের তাড়িতচৌম্বক তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। একই সময়ে সামরিক দায়িত্ব পালন এড়ানোর জন্য তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। এরপর প্রায় পাঁচ বছর তিনি কোন দেশেরই নাগরিক ছিলেন না। ১৯০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব লাভ করেন । এর পর তিনি জুরিখের Eidgenössische Technische Hochschule তথা সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা ইটিএইচ- এ ভর্তি হন।

ইটিএইচে থাকার সময় অনেক বন্ধুর দেখা পান আইনস্টাইন। যাদের সঙ্গে ভাল সময়ে কেটেছে। সেখানেই তার সঙ্গে মিলেভা মেরিকের দেখা হয়। মিলেভা সার্বিয়া থেকে আগত পদার্থবিজ্ঞানের ফেলো ছাত্রী ছিল। তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে গড়ায় এবং এই মিলেভাকেই পরবর্তীকালে বিয়ে করেন আইনস্টাইন। তাদের ঘরে তিন সন্তানের জন্ম হয়।

আইনস্টাইন ১৯০০ সালে ইটিএইচ থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হন। এ সময় তিনি আর্নস্ট মাখের লেখার সঙ্গে পরিচিত হন। এর পর পরই তার গবেষণাপত্র Annalen der Physik সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।

স্নাতক হবার পর ফেডারেল অফিস ফর ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি নামে একটি পেটেন্ট অফিসে চাকরি নেন তিনি। তার চাকরি ছিল সহকারী পরীক্ষকের। তার দায়িত্ব ছিল, আগত পেটেন্টগুলোকে তাড়িতচৌম্বক যন্ত্রের জন্য পরীক্ষা করা। ১৯০৩ সালে সুইস পেটেন্ট অফিসে তার এই চাকরি স্থায়ী হয়ে যায়।

মিশেল বেসো নামে আইনস্টাইনের এক কলেজ সহপাঠীও এই পেটেন্ট অফিসে কাজ করতেন। তারা দুজন অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বার্নের এক জায়গায় নিয়মিত মিলিত হতেন। তাদের মিলিত হবার উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে আলোচনা করা, এভাবে একটি ক্লাবের জন্ম হয়। কৌতুকভরে তারা এই ক্লাবের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য অলিম্পিয়া একাডেমি’। তারা অঁরি পয়েনকেয়ার, আর্নস্ট মাখ এবং ডেভিড হিউমের লেখা খুব বেশি পড়তেন। এরাই মূলত আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তাধারায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল।

১৯০৫ সালে আইনস্টাইন Annalen der Physik সাময়িকীতে চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভর-শক্তি সমতুল্যতার সূত্র (E=mc2)  এই চারটি গবেষণাপত্র বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।

২৬ বছর বয়সে আইনস্টাইন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার উপদেষ্টা ছিলেন পরীক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলফ্রেড ক্লাইনার। তার পিএইডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল,  ‘আ নিউ ডিটারমিনেশন অফ মলিক্যুলার ডাইমেনশন্স’।

১৯০৬ সালে পেটেন্ট অফিস আইনস্টাইনকে টেকনিক্যাল পরীক্ষকের পদে উন্নীত করে। পরে ১৯০৮ সালে বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের privatdozent হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৯ সালে আরও দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।১৯১০ সালে তিনি আরো একটি গবেষণাপত্র লিখেন।

১৯১১ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন আইনস্টাইন। অবশ্য এর পরপরই চার্লস ইউনিভার্সিটি অফ প্রাগে পূর্ণ অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন তিনি।

আইনস্টাইন ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন । তার পুরস্কার লাভের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান এবং বিশেষত আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কিত গবেষণার জন্য।

১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় আসেন। এই সময় আইনস্টাইন বার্লিন একাডেমি অব সায়েন্সের অধ্যাপক ছিলেন। ইহুদি হওয়ার কারণে আইনস্টাইন সে সময় দেশত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যান। পরে আর কখনো জার্মানিতে ফেরেননি। ১৯৪০ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। আইনস্টাইন মিত্রবাহিনীকে সমর্থন করলেও পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন। পরে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্টান্ড রাসেলের সঙ্গে মিলে আণবিক বোমার বিপদের কথা তুলে ধরে রাসেল-আইনস্টাইন ইশতেহার রচনা করেন।

১৯৫৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড স্টাডির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৯৯ সালে টাইম সাময়িকী আইনস্টাইনকে ‘শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে।

 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ এপ্রিল ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়