ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শরীরজুড়ে তার তারের রাজ্য

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৬ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শরীরজুড়ে তার তারের রাজ্য

(ভিয়েতনামের পথে : ৩৩তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: সানডে নাইট বাজার উপলক্ষে থাপায়া গেট এলাকা আজ বেশি জমজমাট। ফ্রাইডে এবং স্যাটারডে বাজার দুটি গেট এলাকা থেকে সামান্য দূরবর্তী হওয়ায় এখানে তার প্রভাব তেমন লক্ষণীয় হয় না। কিন্তু আজকের চিত্র আলাদা। মানুষ বেশি, কবুতরের সংখ্যাও যেন আগের দিনগুলির চেয়ে বেশি। আদার বিক্রেতাদের বেচা বিক্রি ভালোই জমে উঠেছে। গত দুইটি বাজার দেখার সময় হিসেবে নির্ধারিত ছিল রাত। আজ তাড়া নেই। অতএব, বিকেলের বাজরে ছোট্ট করে ঢুঁ মারলে মন্দ হয় না। বাজার জমে উঠতে আরও সময় লাগবে। তাছাড়া এই ধরনের বিনোদনের জন্য রাত উপযুক্ত সময়। তবে বার এবং ক্লাবের আড্ডা কিন্তু ঠিকই জমে উঠেছে। উন্মুক্ত দোকানে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী নানান যন্ত্রের সম্ভার নিয়ে যিনি বসে আছেন, দেখতে স্বয়ং বব মার্লি যেন। শুধু শুধু বসে নেই, গলায় ঝুলানো বিশেষ যন্ত্রে অনবরত টুংটাং বাজিয়েই যাচ্ছেন। আর সেই টুংটাং এর মাঝ থেকে সুর হয়ে বেরিয়ে আসছে মার্লির জনপ্রিয় গান ‘আই ডোন্ট ওয়ানা ওয়েট ইন ভেইন’। ইচ্ছে হলো ‘বাফেলো সোলজার’ গানটার জন্য অনুরোধ করি।

ক্রেতা সমাগম কম হলেও যে কয়জন জড়ো হয়েছে তারা যে সঙ্গীতের সমঝদার নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু কেউ কোন যন্ত্র কিনছে না। আমার তো মন চাইল স্মৃতিস্বরূপ যে কোন একটি কিনে ফেলি। দাম এবং পছন্দে একটি আয়ত্বের মধ্যে পড়ল কিন্তু ভেবে দেখলাম ভ্রমণের এখনও অনেকটাই বাকি। এখান থেকে মালয়েশিয়, তারপর ইন্দোনেশিয়া। এয়ারলাইনগুলি যাত্রীদের ব্যাগেজের বিষয়ে মোটেও যত্নশীল নয়। টেনে-হিঁচড়ে যা-তা পরিস্থিতি। সরানো নরানোর সময় একের পর এক তুলে নিক্ষেপ পর্যন্ত করে থাকে। ইতিমধ্যেই আমার ব্যাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিড়ে ফেলেছে। পছন্দের যন্ত্রটির ধরণই এমন যে সমান্য আঘাতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। সমবেত কেউ যে একটি বাদ্রযন্ত্রও খরিদ করল না। এর জন্য তার কোন অনুযোগ নেই। এমনকি চেহারাতেও তার ছাপ নেই। কে জানে মানুষকে সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ করার মাঝেই হয়তো স্বার্থকতা খুঁজে পান! বেশ খানিকক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখনকার মত এ পর্যন্তই, এবার গেস্টহাউজের ফিরতে হবে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় দ্বিতীয়বারের মত আসা।



হাত মুখ ধোয়ার পর বেশ সতেজ লাগছে। ফেরার পথে কফি নেয়া হয়েছিল। দুজনের সামনে গরম কফি, আলাপ চলছে আগামীকালের পরিকল্পনা নিয়ে। এখান থেকে ব্যাংককের বাস কাল রাত সাড়ে নয়টায়। গেস্টহাউজ ছেড়ে দেয়ার শেষ সময় দুপুর বারোটা। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে কি করা যেতে পারে এটাই ছিল ভাবনা বা পরিকল্পনার মূল বিষয়। কফি আর ভাবনায় পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। ইউবিন এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়ে এসেছে। আজকের বাজার দেখতেও সে আমাদের সঙ্গী হবে। সন্ধ্যার পরপর গিয়ে প্রবেশ করলাম বাজারে। গেট দিয়ে এক সাথে বহু মানুষ ঢুকছে এবং বের হচ্ছে। ভেতরে প্রবেশের পর সোজা যে রাস্তা ওয়াট ফ্রা সিংহার দিকে এগিয়েছে তাতেই আজকের বাজার। এই রাস্তা নগরীর প্রধান পথ। পথে প্রান্তরে কত যে বিষয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তার ঠিকানা নেই! এই তো ভেতরে ঢোকার আগে গেটের বাইরের চত্বরে মানুষের জটলা এবং করতালিতে আমরাও আকৃষ্ট হলাম। এগিয়ে গিয়ে দেখি শব্দ যন্ত্র হাতে একজন হন্তদন্ত, কথা বলছে তো বলছেই, যেন এখনই বিস্ময়কর কিছু একটা করে দেখাবে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। লোকটি ইয়োরোপ-আমেরিকান কোন দেশ থেকে আগত পর্যটক হয়ে থাকবে। কথা এখনও চলমান। তার হাবেভাবে বোঝা যায় যাদু-মন্ত্র কিছু করে দেখাবে। আর সেই লক্ষ্যে মানুষের মনোযোগ এবং সংখ্যা দুটিই বাড়িয়ে নিচ্ছেন। ভ্রমণের ফাঁকে সুযোগ পেলে এসব করে বেড়ানো লোক পৃথিবীতে কম নেই। কথা বলা আর এ-মাথা ও-মাথা ছোটাছুটিতে ঘেমে কাহিল। কথা এবং কায়কারবারে দর্শকদের হাসানোর চেষ্টা করছে কিন্তু দর্শকের প্রতিক্রিয়া মোটেও আশানুরূপ নয়। অথচ, তাকে দেখে মনে হচ্ছে স্বার্থক হওয়ার মত ভীষণ কিছু একটা করছে আর দর্শক হাসি এবং করতালি দিয়ে এলকা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দশ-পনের মিনিট পেরিয়ে গেছে। বুঝতেই পারলাম না কম্বখ্‌তটা আসলে কি করছে! এক পর্যায়ে আসর ত্যাগ করে নিজেকে রক্ষা করলাম।

গতকালের মতো আজকেও একটি মিলন কেন্দ্র নির্ধারণ করা হলো। হারিয়ে গেলে যেখানে দেখা হবে। আজকের বাজারের চিত্র খানিকটা ভিন্ন। পথের উভয় পাশ দিয়ে দোকান এবং ঠিক মাঝখান দিয়ে আরও দুই সারি দোকান। বিক্রেতা ও স্থানীয় দর্শনার্থীদের গায়ে শোকের কালো পোশাক। এক কি দুই দিন পর প্রিয় রাজার শেষকৃত্য। সে উপলক্ষে থাইল্যান্ডবাসী এক বছর ধরে চলমান শোক পালনের শেষ পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। আমরা যখন বাজারের মাঝামাঝিতে ঠিক সেই সময় মাইকে কিছু একটা বাজতে শুরু করল। সাথে সাথে বেচাকেনা বন্ধ করে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পরেছে। চলতি পথও থমকে গেছে। আমরা এগিয়েই চলছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম কেউ একজন শরীর স্পর্শ করল। ফিরে দেখি সটান দাঁড়ানো লোকটি ইশারায় প্রার্থনায় শামিল হতে বলছে। সম্পূর্ণ এলাকায় এমন নীরবতা নেমে এলো যেন কোন বাজার বসেনি এবং এখানে কোন জনসমাগমও নেই। শুধু মাইক থেকে ভেসে আসছে প্রার্থনার বাণী।



দীর্ঘ রাস্তাজুড়ে বাজার। পৌঁছে গেছে থানা পেরিয়ে একেবারে ওয়াট ফ্রা সিংহা এলাকা পর্যন্ত। আজকের প্রদর্শিত হস্তশিল্পগুলির মধ্যে কাঠ ও শেকড় বাকড়ের কর্মই সেরা। পরে থাকা বা কুড়িযে নেয়া কাঠের টুকরো, যার অনেকটাই পঁচে বা খসে যাওয়া। সেই সমস্ত কাঠেই খোদাই করে ফুটে তোলা হয়েছে নানান প্রতিকৃতি। এর মধ্যে হাতি অন্যতম। দেখে মনে হবে কাঠে খোদিত এসব কাজের মধ্যে কোন শিল্পকর্মই যেন পূর্ণতা পায়নি। অথচ, কি অসাধারণভাবে প্রতিটিই একেকটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পকর্ম। যেমন কাঠের একটি টুকরোতে হাতির মাথার নকশা স্পষ্ট হয়ে শুরের সাথে নেমে আসতে আসতে থেমে গেছে, অসম্পূর্ণ রয়েছে অথবা পঁচা বা খসে পরা অংশে বিলীন হয়ে গেছে। এসবের শিল্পমান বিচারের সামর্থ আমার নেই তবে এত চমৎকার সৃজনশীলতা আমি কমই দেখেছি। আর একজন গাছের আঁকাবাঁকা ডাল/কান্ড এবং শেকড় রূপ দিয়েছে অদ্ভুত একেকটি শিল্পে। সৃষ্টি করেছে নানা ভঙ্গিমার মানব প্রতিকৃতি। কোনটিতে দেখা যাচ্ছে মানুষ গিটার সদৃশ্য যন্ত্র বাজিয়ে চিৎকার করে গান গাইছে, কোনটি প্রকাণ্ড পুরুষাঙ্গ দাঁড় করিয়ে ভেংচি কাটছে, আবার কোনটি ঠোঁটে সিগারেট ঠেসে দিয়ে কোছায় বই মেলে গভীর মনোযোগে পড়ছে। পাশে শিল্পী নিজেও বসে আছেন। আমার আগ্রহের মাত্রা বোধহয় তাকে আকৃষ্ট করল, যার কারণে বসা থেকে উঠে নিকটে এলেন। শৈশব থেকেই এসবের প্রতি তার ঝোঁক। কোন পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। আশপাশের পরে থাকা কাঠ, শেকড় ইত্যাদিতে মনের মাধুরী ঢেলে দিয়ে ফুটে তোলেন এসব শিল্প। দুচার কথার পর শিল্পকর্মের পাশে দাঁড়ানো তার একটি ছবি তুলতে চাইলে সম্মতি দিতে কার্পণ্য করলেন না।



রাস্তার পাশে কেউ নৃত্য করছে আবার ঠিক মাঝখানে উঁচু টুলে বসে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা যুবক হাসি হাসি মুখে গিটার বাজিয়ে আনন্দ করছে দর্শনার্থীদের। সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় পরিবেশনা হলো বৃদ্ধ শিল্পীর গান। খুনখুনে বৃদ্ধ, বয়স কমপক্ষে পঁচাশি হবে। তার গান পরিবেশনের তরিকা গতানুগতিক নয়। মোটর সাইকেলে জুড়ে দেয়া অতিরিক্ত অংশ এবং তার উপরে ছাউনি। তিন চাকার এই বাহন তার মঞ্চ। পরনে হাফপ্যান্ট, দুপা দুই পাশে নামিয়ে দেয়া। কাঁধে ঝুলিয়েছেন গিটার, দেহ তারই উপর নূয়ে পরেছে। শরীরজুড়ে তারের রাজ্য। সমস্ত তার গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে শব্দ যন্ত্র এবং রংবেরঙের বাতিগুলিতে। ক্ষীণ শব্দে গান গাইছেন। না জানি কতই কষ্ট হচ্ছে! তবুও থামবার নয়, গেয়েই যাচ্ছেন। দুঃখের বিষয় তাকে ঘিরে তেমন কোনো সমাগম নেই। অস্পষ্ট আর কাঁপা গলার গান শুনতে তেমন কোনো দর্শক নেই। হাতে গোনা যে কয়জনই আকৃষ্ট হচ্ছে তাদের প্রায় সকলেই বৃদ্ধের গান নয় বরং ব্যাতিক্রম আয়োজনের টানে। ভেবেছিলাম বাজার থেকে বেরিয়েই গেস্টহাউজে ফিরে যাব। কিন্তু না, বাইরের চত্বরে এক দল তরুণের বাদ্যযন্ত্র পরিবেশনা উপভোগ করতে গিয়ে আরও কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার তহবিল সংগ্রহে পরিবেশিত হচ্ছে যন্ত্র সঙ্গীত। এর আগে কখনও স্ব-শরীরে স্যাক্সোফোনের বাজনা শোনার অভিজ্ঞতা ছিল না। পাঁচ থেকে সাতটি নোট ঘুরে ঘুরে পরিবেশিত হলো। সোডিয়াম আলোয় সার হয়ে দাঁড়ানো তরুণের দল সমস্বরের যাদুতে পুরো চত্বর মোহিত করে রাখল। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়