ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের জমি দখলের পাঁয়তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ৩০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের জমি দখলের পাঁয়তারা

সুরকার, ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলতাফ মাহমুদের নামে বরিশালে প্রতিষ্ঠিত ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়’ এর জমি দখলের পাঁয়তারা করছেন এক শিল্পপতি ও তার পরিবারের সদস‌্যরা।

অভিযোগ উঠেছে, ওই বিদ্যালয়ের প্রায় ১০ শতাংশ জমি জালিয়াতির মাধ্যমে দখলের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বরিশালের সংস্কৃতিকর্মীরা।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ বিখ‌্যাত এ গানসহ অসংখ্য দেশাত্মবোধক ও উদ্দীপনামূলক গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ। তার নামে বরিশালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়’।

বিদ্যালয়টি রক্ষা ও যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে স্থানীয় সঙ্গীতপ্রেমীদের উদ্যোগে আলতাফ মাহমুদের নামে সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৫ সালে বরিশাল সদরের হাসপাতাল রোডের পাশে ৫০ নম্বর বগুড়া-আলেকান্দা মৌজার ১৩৪ নম্বর খতিয়ানের ৩১৪৮ নম্বর হাল দাগের ৯.৪৬ শতাংশ এবং ১৯৮৬ সালে একই দাগ ও খতিয়ানে আরো ১.৯ শতাংশসহ দুই দফায় মোট ১০.৫০ শতাংশ জমিসহ একটি একতলা পাকা ভবন শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আজিজ আহমেদ।

কালের বিবর্তনে মূল্যবান ওই জমির দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ভূমিদস‌্যুদের। ১৯৯৯ সালে নগরীর রূপাতলীর জনৈক রফিক উদ্দিন আহমেদ রফিজ ও তার পরিবারের সদস্যরা ওই জমির মালিকানা দাবি করে তা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেন জিয়াউদ্দিন হাসান কবিরকে। কিন্তু জিয়াউদ্দিন হাসান কবির সঙ্গীত বিদ্যালয়ের ওই জমির ধারেকাছেও যেতে পারেননি।

২০০৭ সালে ওই জমি সরকারি গেজেটভূক্ত হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে রফিক উদ্দিন আহমেদ রফিজসহ তার পরিবারের সাত সদস্য ফের ওই জমি শিল্পপতি বিজয় কৃষ্ণ দে’র স্ত্রী শৈল বালা দে’র কাছে ১৬ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। কিন্তু স্থানীয়দের বাধার মুখে বিজয় কৃষ্ণ দে ওই জমি দখলে করতে পারছিলেন না। ২০১২ সালে বিএস রেকর্ডেও ওই সম্পত্তি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভূক্ত হয়।

সেই থেকে হাসপাতাল রোডের ওই জরাজীর্ণ ভবনে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছিল। বরিশালে শহীদ আলতাফ মাহমুদের অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন মুছে গেলেও এই সঙ্গীত বিদ্যালয়ের মাধ্যমে আলতাফ মাহমুদ এবং তার অমর সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে পারছিল নতুন প্রজন্ম।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়টি অন্যত্র স্থানান্তর করে ওই জমি দখলের অপচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে অমৃত ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক বিজয় কৃষ্ণ দে’র বিরুদ্ধে। তিনি বিদ্যালয়টি স্থানান্তরের জন্য নগরীর কালীবাড়ি রোডে একটি ঘরও ভাড়া করেন। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি না হলে ভেস্তে যায় তার পরিকল্পনা। পরে তিনি ২০১২ সালে বরিশালের যুগ্ম জেলা জজ ও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আদালতে ভিপি স্যুট মামলা করেন।

গত ২৫ মার্চ বরিশালের যুগ্ম জেলা জজ ও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আদালতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৩৪০/৬৮-৬৯ নম্বর লিজ কেসের মাধ্যমে ওই জমি শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়কে দেয়া হয়। ১৯৭২ সাল থেকে ওই স্থানে বিদ্যালয়টি সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে। ওই জমিতে সরকারের পক্ষে লিজপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাদী শৈল দে বা অন্য কারোর কোন স্বত্ব বা দখল নেই।

ওই জমিতে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড দিয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনাসহ বিদ্যুৎ বিল এবং সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়মিত পরিশোধ হয়ে আসছে।

বরিশালের সঙ্গীতপ্রেমী আব্দুর রাজ্জাক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল উদ্দিন খান বলেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদ দেশবরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার নামে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয়ের জমি কোনোভাবেই বেহাত হতে দেব না।

সাংস্কৃতিক কর্মী আবিদুর রহমান বলেন, বিজয় কৃষ্ণ দে তার বড় ভাই অমৃত লাল দে’র নামে কলেজ করে অনেক সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করেছেন। এখন তার দৃষ্টি পড়েছে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের জমির দিকে। বরিশালবাসী তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো মানুষ তার জবরদখল মেনে নেবে না।

শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনন্যা বিশ্বাস, হিমাদ্রি সরকার ও অর্পিতা রায় অর্থি প্রতিষ্ঠানটি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন আলতাফ মাহমুদ। সুতরাং দেশ ও জাতির দায়িত্ব আছে তার নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান রক্ষা করার। কেউ যদি ওই জমি দখল করতে আসে, তাদের প্রতিহত করা হবে।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত বিজয় কৃষ্ণ দে বলেন, বর্তমানে যেখানে সঙ্গীত বিদ্যালয়টি আছে, সে সম্পত্তির মালিক ছিলেন লুৎফুন্নেছা বেগম। ওই জমির মালিকানা নিয়ে দায়ের করা মামলায় তিনি উচ্চ আদালতে রায় পাওয়ার পর এই সম্পত্তি শৈল বালা দে’র কাছে বিক্রি করেন এবং দখল বুঝিয়ে দেন। সরকারের ভিপি ঘোষণার পর শহীদ আলতাফ মাহামুদ সঙ্গীত বিদ্যালয় ১৫/১৬ বছর আগে এক সনা লিজ নিয়েছিল। এতে কোনো মালিকানা বা বৈধ অধিকার অর্জিত হয়নি। সরকারপক্ষ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের ৬(১) ধারা উপেক্ষা করে এই সম্পত্তি (ক) তফসিল ভিপি তালিকাভুক্ত করেন। শৈল বালা দে (ক) তফসিল ভিপি আদেশ বেআইনি ঘোষণার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ৩০০/১২ অবমুক্তি মোকদ্দমা দায়ের করেন। তা বতমানে বিচারাধীন আছে। আইন ও মহামান্য আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে সরকারি কোনো প্রশাসন বা সচেতন জনগণ এই সম্পত্তি শহীদ আলতাফ মাহামুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সম্পত্তি বলতে পারেন না।

এ ব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের নামে বরিশালে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসন থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ভিপি সম্পত্তি বরাদ্দ দেয়া হয়। সম্প্রতি এক ব্যক্তি ওই জমি তার নিজের দাবি করে আদালতে মামলা করেছেন। জেলা প্রশাসন থেকে আদালতে জবাব দাখিল করা হয়েছে। ওই সম্পত্তি ভিপি সম্পত্তি হিসেবেই থাকবে এবং সেখানে শহীদ আলতাফ মাহমুদের নামে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয়টি সুন্দরভাবে পরিচালিত হবে।


বরিশাল/জে খান স্বপন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়