শিক্ষার আলোই যার চোখের আলো
চোখের আলো নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা সুধীর চক্রবর্তীর পুত্র সঞ্জিত চক্রবর্তী। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার আগেই চোখের সে আলো নিভে যায় তার।
রোগে আক্রান্ত হয়ে সেই কিশোর বয়সেই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে বলেও কারোর ওপর নির্ভরশীল হতে চাননি। জীবনের চাকা থামতে দেননি, শিক্ষার আলোতে ভর করেই পাড়ি দিয়েছেন জীবনের পথ।
তার চোখের আলো না থাকলেও মনের শক্তি প্রবল। বর্তমানে তিনি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের গঙ্গানগর গ্রামের বাসিন্দা। তাকে সকলেই এ এলাকায় শিক্ষক হিসেবে চেনে।
তিনি গ্রামের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন। সকাল-বিকাল বই, খাতা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে কোমলমতি শিশুদের তার বাড়ির উঠোনে মাদুরে বসে পড়তে দেখা যেত। তাদের নিরলস পাঠদান করাতেন সঞ্জিত চক্রবর্তী। তার শেষ ইচ্ছা ছিল একটি স্কুলঘর। কেউ এ স্কুলঘরটি নির্মাণ করে দেয়নি। আর দিয়েও লাভ হবে না। কারণ শিক্ষক সঞ্জিত চক্রবর্তী অসুস্থ হয়ে বিছানায় রয়েছেন। অর্থাভাবে চিকিৎসাও চলছে না।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের লগ্নে কথা হলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই শিক্ষকের সঙ্গে। একান্ত কথাবার্তার চুম্বক অংশ এখানে তুলে দেওয়া হলো:
রাইজিংবিডি: আপনি কেমন আছেন?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: ভালো নেই। অন্ধ হয়ে কি করে ভালো থাকা যায়, তারপর আবার বয়স হয়েছে। অসুস্থ হয়ে বিছানায় রয়েছি। কোন সময় যে পরপারে চলে যাব। অর্থাভাবে চিকিৎসা ব্যহত হচ্ছে। স্বজন ছাড়া তেমন কাউকে পাশে পাচ্ছি না। আর্থিক সহায়তা পেলে পূর্ণ চিকিৎসা করাতে পারতাম।
রাইজিংবিডি: আপনি কীভাবে দৃষ্টিশক্তি হারালেন, আর কেমন করে শিক্ষকতার এই মহান কাজে এলেন?
সঞ্জিত চক্রবর্তী : মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। শ্রীমঙ্গল আছিদউল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে আমার চোখে সমস্যা দেখা দেয়। এসএসসি পরীক্ষা শুরু হলেও আমি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। টাকার অভাবে আমার চোখের উন্নত চিকিৎসা হয়নি। এতে আমি অন্ধ হয়ে যাই। একসময় বেড়াতে আসি মামার বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার গঙ্গানগরে। এ সময় মামা আমাকে বলেন সঞ্জিত তোর মামাতো ভাই সমীরণ চক্রবর্তী শঙ্কুকে লেখাপাড়ায় সহায়তা কর। আমি মুখে মুখে বলে তাকে সহায়তা করলাম। সেও আমার শেখানো তথ্য শ্রবণ করে ভালো রেজাল্ট করল। অন্ধ হয়েও এভাবে আমি শিশু থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেওয়া শুরু করলাম। শিক্ষার্থীরাও ভালো ফলাফল অর্জন করতে শুরু করল। আমি আর বাড়ি ফিরে যাইনি। মামার বাড়িতে ঘর করে স্থায়ীভাবে বসবাস করি।
রাইজিংবিডি: কত দিন ধরে পড়াচ্ছেন? মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা কত?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: ১৯৮০ সাল থেকে ৩৫ বছর ধরে ৬ হাজারের ওপরে শিক্ষার্থীকে আমি পড়িয়েছি, অসুস্থ থাকায় এখন পড়াতে পারছি না।
রাইজিংবিডি: আপনার অন্ধ জীবনে বেশি কার সহায়তা পেয়েছেন?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: অন্ধ জীবনে আমার সংসারে এসেছে শুক্লা চক্রবর্তী। আমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছে। তিনি আমাকে বেশি সহায়তা করছেন। স্ত্রীকে নিয়ে গর্ববোধ হয় আমার। কারণ আমি অন্ধ। তিনি আমাকে মেনে নিয়ে সংসার করলেন। শুরু থেকে বিরামহীনভাবে সার্বিক সহায়তা করছেন। আমাদের দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে স্বামীর সংসারে রয়েছে। এভাবে কেটে গেছে আমার ৪৭ বছর।
রাইজিংবিডি: আপনি কীভাবে সংসার পরিচালনা করতেন, অসুস্থ থাকায় এখন কি অবস্থা?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: আমার কোনো জমিজমা নেই। আর ছেলেও নেই। কঠোর পরিশ্রম করে রোজগার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা আমাকে মাসিক যা দিতেন তাই দিয়ে ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকতাম। আমার শিক্ষার্থীরা কেউ ওসি হয়েছে, কেউ প্রবাসে, আবার কেউ সেনাবাহিনীতে, এভাবে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে রয়েছে। এটাও আমার একটা বড় পাওয়া। আর ডালভাতই আমাকে ভালো রাখছিল। এর চেয়ে ভালো খাবার খেতে চাই না। কিন্তু অসুস্থতায় এ ডালভাত খাওয়ায়ও সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় স্বজনরা দেখছেন। কিন্তু এভাবে কতদিন?
রাইজিংবিডি: ছাত্র পড়াতে আপনার কি সমস্যা হতো?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: সমস্যা তো কিছু হতো। বলতে চাই না। যদিও টাকার অভাবে স্কুলঘর নির্মাণ করতে না পারায় বাড়ির উঠোনে মাদুরে বসিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতেও রোদ-বৃষ্টিতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল। আর অসুস্থ হবার পূর্বে আমার শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৫০ জনের ওপরে। তাদের বসতে কষ্ট হচ্ছিল। অসুস্থ হওয়ায় স্কুল বন্ধ।
রাইজিংবিডি: আপনি শিক্ষার্থীদের কীভাবে পাঠদান করাতেন?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: স্ত্রী শুক্লা সময় হলেই আঙিনায় বিছিয়ে রাখতেন মাদুর। সবাই এসে বই নিয়ে বসে থাকত। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি হাজির হতাম। শুরু হয়ে যেত লেখাপড়া। শিক্ষার্থীরা বই পড়াতে মগ্ন। আর আমি বসে মুখে মুখে তাদের পাঠ দিতাম। এ দৃশ্য দেখে যে কারোর অবাক লাগছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি আমি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক শেখাতাম। আর শিক্ষার্থীরাও মনোযোগ সহকারে এসব শ্রবণ করতো। সকালে ও বিকেলে স্কুল সময়ের আগে-পরে এদের পড়াশুনা চলছিল।
রাইজিংবিডি: আপনার চোখের ব্যাপারে এখন ডাক্তার কী বলছে?
সঞ্জিত চক্রবর্তী : ডাক্তার আমার চোখ পরীক্ষা করে দেখে বলেছেন, চোখের রেটিনা শুকিয়ে গেছে। এখন আর ভালো হওয়া সম্ভব নয়। তারপরও মোটা অঙ্কের টাকায় চিকিৎসা করালে ফল ভালো আসতে পারতো। যাই হোক আমার অত টাকা নেই। তবে মন ও মেধা অন্ধ হয়নি। আমি ঘরে বসে না থেকে বাড়িতে নিজ উদ্যোগে স্কুল চালু করে শিশুদের পাঠদান করাচ্ছিলাম। এতে আমার ভালো লাগতো। প্রায় স্বেচ্ছাশ্রমে আমি এ স্কুল পরিচালনা করেছি। দারিদ্র্যের কারণে স্কুলঘর নির্মাণ করতে পারিনি। একটি স্কুলঘর হলে আমি আরো স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে পারতাম। কিন্তু এখন আর স্কুলঘর নির্মাণ করে লাভ হবে না, আমি গুরুতর অসুস্থ।
রাইজিংবিডি: স্থানীয় সমাজসেবকরা আপনাকে কেমন চোখে দেখেন?
সঞ্জিত চক্রবর্তী : স্থানীয় সাবেক মেম্বার হেলাল আমাকে শ্রদ্ধা আর মায়া করেন। তিনি এলাকায় বলে বেড়ান, সঞ্জিত স্যার একজন মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করিয়েছেন। আজ তিনি অসুস্থ। তাকে সবাই সহযোগিতা করা প্রয়োজন। স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ আলীও বলেন, দাদার তুলনা হয় না। আমাদের সঞ্জিত দাদা অতিকষ্টের মধ্যেও এলাকার সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তার (আমার) ঋণ এই শোধ হবার নয়। বাদ দেওয়া যাবে না উপজেলা শিক্ষা অফিসকেও। তারাও আমাকে ভালোবাসে।
রাইজিংবিডি: পরিশেষে বলুন, আপনার শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: আমার শেষ ইচ্ছা ছিল একটি স্কুলঘর নির্মাণ। এখানেই আমার যেন মরণ হয়। আমার ইচ্ছা কেউ পূরণ করেনি। আর পূরণ করা প্রয়োজন হবে না। আমি আজ অসুস্থ হয়ে ঘরে রয়েছি। চিকিৎসার জন্য নেই অর্থ। আর কিছুই চাই না আমি- বলেই তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
রাইজিংবিডি: আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আপনার কি চাওয়া?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: শিক্ষকরা যেন নিজ নিজ অবস্থা থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে সুশিক্ষা ছড়িয়ে দেন। এ দিবসে তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে তাকে স্মরণ করার জন্য রাইজিংবিডি পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
রাইজিংবিডি: বর্তমানে কিভাবে পরিবার চলছে?
সঞ্জিত চক্রবর্তী: ৩ শতক জমি ছিল বিক্রি করে দিয়েছি। এ টাকায় জীবিকা নির্বাহ করছি।
স্ত্রী শুক্লা চক্রবর্তী জানান, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ায় তার স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি চলাফেরা করতে পারছেন না। প্রথমে তাকে চিকিৎসার জন্য ছোট মেয়ে তুলি চক্রবর্তী তার শ্বশুরবাড়ি মৌলভীবাজারে নিয়ে গিয়েছিল। এখন অর্থাভাবে হবিগঞ্জেই চিকিৎসা করানো হচ্ছে। তবে তা যথেষ্ট নয়।
শুক্লা চক্রবর্তী জানান, অসুস্থতার কারণে তিনি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন আমাদের সঙ্গে ভালভাবে কথা বলতে পারছেন না। তবে, সঠিক চিকিৎসা পেলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। এজন্য সমাজের বিত্তবানদের কাছে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করেন।
হবিগঞ্জ/মোঃ মামুন চৌধুরী/শাহ মতিন টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন