ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শিরিন তবু মাথা নোয়াবার নয়

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিরিন তবু মাথা নোয়াবার নয়

ঘাটে লোক সমাগম হলে ব্যস্ততা বাড়ে তার। স্বচ্ছ কাপে লাল চা হাতে হাতে ঘোরে। বিস্কিট। টোস্ট। পান। সিগারেট। কেউ মাত্র এসে বসেছেন; কেউ-বা উঠে যাচ্ছেন। কানে ভেসে আসে ট্রলারের ভট্‌ভট্‌, মোটরবাইকের ভোঁ ভোঁ শব্দ। উড়ে যায় সিগারেটের ধোঁয়া। সকাল-বিকাল ঘাটে ঠাসা ভিড়। শহরমুখো কিংবা ঘরে ফেরা মানুষের আনাগোনা। এসময় খেয়া ঘাটের রোজগারী শিরিন আক্তারের ব্যস্ততাও বাড়ে। তখন স্বর্ণা আর ঝর্ণার আবদার কানে তোলার সুযোগ নেই তার। তবুও গা ঘষাঘষি করে কানে কানে কিছু কথা ওরা বলে যায়।

বাঁধের ধারে লম্বা খুঁটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে দোকান ঘরটি।পাটাতনের ওপরে সাজানো দোকানের মালামাল। সামনে গ্রাহকের বসার জন্য পেতে রাখা হয়েছে লম্বা আসন। শিরিন আক্তারের ঘর-সংসার এটাই। দোকান লাগোয়া পাশের ছোট্ট টং ঘরেই বসবাস। দোকানের আয়ে চলে সংসার। ভোর হলে দোকান খুলেন; এখানেই থাকেন রাত পর্যন্ত। নানামূখী ঘাত-প্রতিঘাতে টিকে থাকা শিরিনের জগত এই দোকান ঘিরে। এখানেই রান্না, খাওয়া, দুই মেয়ের দুরন্তপনা- সবকিছু। এত খাটুনির পরও উপকূলের সংগ্রামী এই নারীর মুখ থেকে একটু সময়ের জন্যেও হাসি বিলীন হতে দেখিনি। যেন সর্বদা প্রাণোচ্ছ্বল এক অদম্য নারীর প্রতিকৃতি।

ঘাটের নাম বাবুগঞ্জ। ছোট লঞ্চ, ট্রলার, স্পীডবোট ছাড়ে ঘাট থেকে। গন্তব্য কচ্ছপিয়া। মানে চরফ্যাসন সদরে যাওয়ার পথ। এতক্ষণে অনেকেই হয়তো বুঝে ফেলেছেন- বাবুগঞ্জ ঘাট কোথায়? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এটি উপকূলীয় জেলা ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার সর্বদক্ষিণে দ্বীপ কুকরী মুকরীতে। এ দ্বীপে বেড়াতে আসা অনেকের চোখেই পড়বে শিরিন আক্তারের দোকানটি। এক সময় সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি ছিল। কিন্তু জীবিকার তাগিদে সেসব এখন অতীত। স্বামী জয়নাল আবেদীন একবার স্ট্রোক করায় আরও চাপ বাড়ে শিরিনের। তবুও দমে যাননি। জীবনে এসেছে দুঃখ, যন্ত্রণা, শিরিন তবু মাথা নোয়াবার নয়।

ভর দুপুরে, তপ্ত রোদের মাঝে হাঁটছিলাম বাবুগঞ্জের পথ ধরে। খানিক ইট বিছানো, খানিক কাঁচা মেঠোপথ। প্রায় প্রত্যেক জীবনেই থাকে বড় বড় গল্প। টানাপোড়েন, ঘাত-প্রতিঘাতের ঘটনাবলী। অনেক গল্প হয়তো অজানাই থাকে; কিন্তু শিরিনের গল্পটা হয়ে ওঠে খবর। লাল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সেই গল্পই শুনছিলাম। শিরিনের গল্পের সঙ্গে তার প্রয়াত বাবা আবদুল হকের গল্পটাও জড়িত। সত্তর সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে আবদুল হক ভেসে এসেছিলেন কুকরী মুকরীতে। বাবা-মা কেউই ছিল না তার। এর অনেক দিন পর আরেক ঝড়ে তারাও ভেসে যান। এতিম কিশোর আবদুল হক বড় হয়েছেন কুকরির মজুমদার বাড়িতে। মহিষ দেখাশোনা করতেন। বড় হওয়ার পর আবদুল হকের বিয়েও করিয়েছে তারা।

দিন গড়ায়। সময় বদলায়। মজুমদার বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে নিজের জগত গড়ে নেন আবদুল হক। স্ত্রী জহুরা বিবি আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। ৪ মেয়ে আর এক ছেলে তার। আবদুল হকের অবস্থা বেশ ভালো হয়ে ওঠে এক সময়। কিন্তু একবার নির্বাচন করায় বেশ আর্থিক সংকটে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি কাঁচা তরকারির ব্যবসা শুরু করেন। বরিশাল থেকে তরকারি আনতে গিয়ে  সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে। কুকরিতেই ছোট্ট ঘরে বসবাস করতেন আবদুল হক। আর ছোট মেয়ে শিরিন আক্তার বাবার ঘরের সামনেই সরকারি জমিতে ঘর তুলে থাকতেন। কিন্তু সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। অবশেষে শিরিনের আসতে হলো বাঁধের ধারে।

আর্থিক দৈন্য, বাবার মৃত্যু, নানান প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে জীবন এলোমেলো শিরিনের। স্বামী জয়নাল আবেদীনের ফার্নিচারের দোকান ছিল কুকরী বাজারে। সে দোকান টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। পরে চিংড়ির পোনার ব্যবসাও করেছেন। হঠাৎ অসুখে পড়েন জয়নাল। ফকির-কবিরাজ অনেক দেখিয়েছেন। এক পর্যায়ে ব্রেইন স্ট্রোক করেন। ফলে বিপাকে পড়েন শিরিন। অসুস্থ স্বামী, দুই কন্যাশিশু আর সংসার নিয়ে তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজনের অনুমতি নিয়ে এখানে একটি দোকান আর থাকার জায়গা পেয়েছেন- জানালেন শিরিন। দোকানের মালামাল তোলার জন্য কালাইয়ায় বোনের কাছ থেকে কিছু সহায়তাও পেয়েছেন।

দোকান কেন? প্রশ্ন করতেই শিরিন জবাব দেন, এক সময় দোকান ছিল। তা ছাড়া মহিলা মানুষ হিসাবে আমার পক্ষে আর কী করা সম্ভব? সব দিক বুঝে দোকান করার চিন্তা করি। তার কথা শুনতে শুনতে দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখি ঠাসা মালামাল। মুদি মালামাল থেকে শুরু করে নানান কিছু। চলতি পথের যাত্রীদের জন্য চা-পান-সিগারেট রাখতে হয়। দোকানের সামনেই নিজের বসার জলচৌকির সামনেই জ্বলছে কেরোসিন কুকার। তার ওপরে গরম চায়ের কেটলি। স্বামী কখনো তাকে সহায়তা করে। তবে স্বামীকে ছাড়াই যাতে দোকান চালাতে পারেন, শিরিনের প্রস্তুতি সেরকমই। এক মালিককেই দেখলাম দোকানের সব কাজ করতে।

দোকানে বেচাকেনা কেমন? জানতে চাইলে শিরিন বলেন, এক থেকে দেড় হাজার টাকা প্রতিদিন বেচাকেনা হয়। সংসারে দৈনিক খরচ তিন-চারশ টাকা। চরফ্যাসনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল আনেন। তবে তাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। অর্ডার করলেই মালামাল চলে আসে। আর ঘাটে বসেই বেচাকেনা করেন শিরিন। বেশ ভালোই চলে যায় দিন। কিন্তু স্বামীর অসুস্থতায় ধারদেনা তাকে পিছনে টেনে রাখছে। স্বামীর চিকিৎসার জন্য প্রথমে ৭০ হাজার এনেছেন বোনের কাছ থেকে। ঘরে গচ্ছিত দুটি স্বর্ণের আংটি বিক্রি করেছেন। সুদে এনেছেন আরও ১০ হাজার টাকা। দরগাহ, ফকিরকে দিয়েছেন আরও ১০ হাজার টাকা। এসব দেনার বোঝা টানতে গিয়ে এগোতে পারছেন না তিনি। তবে ভেতরে অন্তর্নিহিত কষ্টের কথা কাউকে বুঝতে দেন না। ফুটফুটে দুই মেয়ে নিয়ে তার যেন এক সুখের সংসার!

ঝড়-বৃষ্টিতে বাঁধের ধারে এই ঘর নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই শিরিনের। জোয়ারের পানি বাড়লে পানি উঠে আসে পাটাতনের কাছাকাছি। বড় ঝড় হলে আরও ভয় হয়। প্রবল বাতাসে নাড়িয়ে দেয় ঘর। তখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এ তল্লাটে নারী পরিচালিত দোকান আর চোখে পড়ল না। রক্ষণশীল সমাজে নারীরা যেখানে ঘর থেকে বের হন না; শিরিন সেখানে নিজেই ব্যবসা করে একটি সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। হয়ে আছেন বহু নারীর অনুকরণীয়।

বেলা গড়িয়ে পড়েছে। সূর্যের তেজ কিছুটা কমেছে। দোকানের পাশ দিয়ে নদীর দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেল কতগুলো মহিষ ছুটছে ওপার থেকে এপারে। পেছনে মাথায় গামছা প্যাঁচানো বাথান, হাতে লাঠি। এগিয়ে চলে মহিষের পেছনে পেছনে। শিরিনের দোকানে নেই দুপুরের বিরতি। রান্না হয়েছে অনেক আগেই। খাওয়া শেষে দুই মেয়ে ঘরের দুয়ারে হাতে মেহেদি রাঙাতে ব্যস্ত। আমি ফিরি এমন আরও জীবনের গল্পের খোঁজে।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়