ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শ্রমিকের কল্যাণে নেই কল্যাণ ফাউন্ডেশন!

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৯, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্রমিকের কল্যাণে নেই কল্যাণ ফাউন্ডেশন!

হাজারীবাগের কালু লেদার ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন আলমগীর হোসেন। ২০১৮ সালের মার্চে মেশিনে বাম হাত ঢুকে গেলে তার তিনটি আঙ্গুল কেটে যায়।

আলমগীর হোসেনের অভিযোগ ছিল, মেশিনে সমস্যা থাকায় তার আঙ্গুলে কেটেছে। ওই ঘটনার পর হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা নেন তিন। প্রায় দুই মাস পর আবারো কাজে ফেরেন আলমগীর। সংসাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় এক হাতেই কাজ করতেন। এরমধ্যে তার কাটা আঙ্গুলে ইনফেকশন হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সেখান থেকে পচন শুরু হয়। আর্থিক সামর্থ না থাকায় চিকিৎসা করাতে পারেননি। অবশেষে চলতি বছরের ২২ আগস্ট মারা যান আলমগীর।

দুর্ঘটনার পর আলমগীর হোসেন ট্রেড ইউনিয়নের এক নেতার মাধ্যমে খোঁজ পান শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের। চিকিৎসার জন্য আবেদনও করেন তিনি। তবে মারা যাওয়ার পরও তিনি বা তার পরিবার কোনো আর্থিক সহায়তা পায়নি।

আলমগীরের স্ত্রী শামসুন নাহার স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কখনো কোথাও চাকরি করেননি। এখন তিনি একমাত্র মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মেয়েটি সাভারের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। 

সম্প্রতি রাইজিংবিডির সাথে আলাপকালে শামসুন নাহার জানান, মেশিনে সমস্যা থাকায় আলমগীরের বাম হাতের মাঝের তিনটি আঙ্গুল কেটে যায়। টাকার অভাবে তার সঠিক চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যে প্রাথমিক চিকিৎসা হয়তো হয়েছে। কিন্তু আলমগীর যেখানে কাজ করতেন সেখান থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের কাছে আবেদন করে এক বছরেও এক কানাকড়ি পাননি।

শুধু আলগমীর হোসেনের স্ত্রী শামসুন নাহার নয়, কর্মক্ষেত্রে হতাহত, অসুস্থতায় আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়া পোশাক শ্রমিক নিরু তাজ, ট্যানারী শ্রমিক মো. সুমনসহ অনেক শ্রমিক বা তাদের পরিবার বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে আবেদন করেও কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। 

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ডা. এএমএম আনিসুল আউয়াল রাইজিংবিডিকে বলেন, ফাউন্ডেশনটি একটি পূর্ণাঙ্গ আইনের আওতায় পরিচালিত হয়। কিন্তু সীমিত জনবল এবং জনসচেতনতার অভাবে আমরা এখনো সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি না। তবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় যেসব শ্রমিক সহায়তার জন্য আবেদন করে আমরা তাদের সাহায্য করছি।

তিনি বলেন, এই তহবিলের কার্যক্রম সর্ম্পকে অনেকেই জানে না, আবার অনেকের জানার মধ্যেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই আমি মনে করি ফাউন্ডেশনের পক্ষে সচেতনতা সৃষ্টি, আমাদের উদ্দেশ্যপূরণ এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়াতে পারে।

আরো বেশি শ্রমিকদের সুবিধাভোগীর আওতায় আনতে কিংবা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম বাড়াতে নতুন কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত আমাদের কার্যক্রম বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুসারেই পরিচালিত হচ্ছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে ভবিষ্যতে নতুন উদ্যোগ বা পরিকল্পনা আসতে পারে।

বিভিন্ন শ্রমিক আবেদন করেও কল্যাণ তহবিল থেকে কোনো রকম সাহায্য না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক বলেন, সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেদন আসলে কখনোই কেউ বিফল হয় না। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হয় সচেতনতার অভাব এবং সঠিক তথ্যের অভাব। যে কারণে সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেদন আসে না। অনেক সময় আবেদনের প্রেক্ষিত, বিষয়বস্তু ‍এবং পরিস্থিতিও বিবেচনায় আনা হয়।

২০০৬ সালে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন প্রণয়ন করা হয়। এর কার্যকারিতা শুরু হয় ২০১৩ সাল থেকে।  ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসেবে, ২০১৬ সালের জুন থেকে গত তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি মৃত, অসুস্থ শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা এবং শিক্ষা খাতে ৬ হাজার ১৬০ জনের মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।

এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মৃত ১২৬, চিকিৎসার জন্য ৩ হাজার ৪২২ এবং শিক্ষার জন্য ২৮২ জনকে আর্থিক সহায়তা দেয় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন। এছাড়া শুরু থেকে এ পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে শ্রমিকদের গোষ্ঠী বীমায় অন্তর্ভুক্ত ২ হাজার ৫০০ জনকে ৫৪ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫০ টাকা প্রিমিয়াম বাবদ দেওয়া হয়েছে।

চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানি মিলে মোট ১৪০টি প্রতিষ্ঠান এসব অর্থ জমা দিয়েছে। এসব টাকা কল্যাণ তহবিলের নামে সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় জমা রাখা‌ হয়।

আইনে অক্ষম শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য, অসুস্থ শ্রমিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা বা আর্থিক সহায়তা দেওয়া, দূর্ঘটনায় শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারকে সাহায্য দেওয়া এবং শ্রমিকের পরিবারের মেধাবী সদস্যকে শিক্ষার জন্য বৃত্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে। ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত শ্রমিক বা তার পরিবারকে দেওয়ার বিধান রয়েছে।

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন সূত্র বলছে, সাহায্য চেয়ে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজারের মতো আবেদন সেখানে জমা হয়।

শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সেফটি অ্যান্ড রাইট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সেকান্দার আলী মিনা রাইজিংবিডিকে বলেন, গত দুই বছরে সব প্রক্রিয়া মেনে ৫০ জন শ্রমিকের জন্য ফাউন্ডেশনে আমরা আবেদন করেছিলাম। এদের মধ্যে দুই/তিনজন শ্রমিক সহায়তা পেয়েছেন। অনেকের সঙ্গে ফাউন্ডেশন যোগাযোগই করেনি। ২০০৬ সালের আইন অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে সমাধান হওয়ার কথা।  তিনি বলেন, অনেক আহত শ্রমিক আছে যারা ফাউন্ডেশনের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আর্থিক সহায়তা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। অথচ শত শত কোটি টাকা ফাউন্ডেশনের তহবিলে পড়ে আছে। কিন্তু শ্রমিকরা টাকা পাচ্ছেন না। দ্রুততার সাথে শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলে এত টাকা পড়ে থাকতো না।


ঢাকা/নূর/নবীন হোসেন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়