শ্রুতি নাটক || আত্মহত্যা
ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম
একজন পুরুষ আর একজন নারী কথা বলছে। কাছেই কোথাও চামচের টুং টাং শব্দ শোনা যায়। তারা কথা বলতে থাকে।
নারী: আমাদের এর আগে দেখা হয়েছিল?
পুরুষ: ঠিক মনে করতে পারছি না।
নারী: আপনাকে চেনা চেনা মনে হয়, কোথায় যেন দেখা হয়েছিল।
পুরুষ: এই ছোট পৃথিবীতে অনেক জায়গায় দেখা হতে পারে।
নারী: আমারও তাই মনে হয়- সেদিন আপনার পরনে ছিল নীল পাঞ্জাবি।
পুরুষ: হুম অনেক বছর আগে এই রঙের একটি পাঞ্জাবি কিনেছিলাম। বেশ কয়েকদিন আগে তেলাপোকায় কেটেছে।
নারী: তেলাপোকার খাবার ছিল সেটি।
পুরুষ: হুম।
নারী: শুনে আনন্দ পেলাম।
পুরুষ: আনন্দ!
নারী: হ্যাঁ আমার দেখা একটি জিনিস পৃথিবী থেকে মুছে গেছে- এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? আমার সাথে আপনার দেখা হওয়ার সময় আপনার বাড়িতে নীল পাঞ্জাবি ছিল।
পুরুষ: ঠিক তাই।
নারী: আপনাকে একটি কথা বলার ছিল।
পুরুষ: বলুন।
নারী: এখানে লোকটাকে খুন করা হয়েছিল।
পুরুষ: কখন?
নারী: একটু আগে। মরার আগে একবার সে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
পুরুষ: অচেনা মানুষের মৃত্যু।
নারী: ও।
পুরুষ: লোকটাকে দেখতে পেলে ভালো হতো।
নারী: আয়নায় তাকালেই দেখতে পাবেন।
পুরুষ: আশ্চর্য!
নারী: একখানা লিপস্টিক নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ান। তারপর আপনার চোখের চার আঙুল নিচে লম্বা দাগ টেনে নিলেই হবে।
পুরুষ: লোকটা মরবার আগে কিছু বলেছিল?
নারী: হুম তবে সেটা আপনাকে বলা ঠিক হবে না।
পুরুষ: আহা বলুন তো।
নারী: আপনাদের মন মরে গেছে, বুক খুলে কাঁদতে ভুলে গেছেন।
পুরুষ: কথাটা মিথ্যে নয়। এই কষ্টেই কী সে মরে গেল!
নারী: কয়েকদিন আগে একটি বাস আগুনে পুড়লো।
পুরুষ: হ্যাঁ, নয়জন লাশ আর পনেরো জন অর্ধলাশ।
নারী: দেখুন কী অবলীলায় বলে ফেললেন বুক একটুও কাঁপলো না।
পুরুষ: আসলে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে।
নারী: এ কারণেই সে নিজেকে হত্যা করলো।
পুরুষ: আহা! তাঁর সঙ্গে কথা হলে ভালো হতো। কিন্তু আপনি এতোসব জানলেন কেমন করে?
নারী: তার ডাইরি পেয়েছিলাম।
পুরুষ: ও।
নারী: অনেক শখ ছিল তার।
পুরুষ: যেমন আমাদের থাকে।
নারী: হুম লিখে গিয়েছে অনেক কথা।
পুরুষ: তিনি নিশ্চয়ই অনেক পড়তেন।
নারী: হ্যাঁ তার বইয়ের সংখ্যা দেখে তাই মনে হয়, প্রায় পাঁচ হাজার বই আছে তার।
পুরুষ: ওরে বাবা বিশাল বইয়ের দরবার!
নারী: তা বলতে পারেন, ঘরজুড়ে বই আর বই।
পুরুষ: তাহলে তার নামে করা যাবে একটি পাঠাগার, সেখানে তার ডাইরি আর প্রিয় বইগুলো-
নারী: নাহ্ ঐ হিসাব সে রেখে গেছে, আমাদের ভাবতে হবে না সেসব নিয়ে।
পুরুষ: বাহ্ বুদ্ধিমান লোক।
নারী: টনটনে হিসাব তার।
পুরুষ: তবে আর কী, যদি পাঠ করে থাকেন তার ডাইরি সেখান থেকে শোনান। জেনে নেই আছে কার ভাগে কতটুকু।
নারী: বলে গেছে সব পুড়িয়ে ফেলতে।
পুরুষ: আবার বলুন।
নারী: বলে গেছে সব পোড়াতে।
পুরুষ: বই খাতা?
নারী: কিছুই রাখতে বলেনি। শুধু বলেছে, আসছে এক অন্ধকার। সে অন্ধকারে আলো রাখা বিপজ্জনক।
পুরুষ: ওহ্ ভয়ঙ্কর লোক।
নারী: তা বলতে পারেন।
পুরুষ: এমন করে এর আগে কাউকে লিখতে দেখিনি। জ্ঞান সে পুড়িয়ে ফেলতে চায়। ছাই করতে চায়।
নারী: তা বলতে পারেন।
পুরুষ: তার বাড়ির সামনে ভাস্কর্য চাই একটা যে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
নারী: শেষ করিনি সবটুকু- বলার আছে আরও কথা। চায়নি কোনো ভাস্কর্য হোক তার।
পুরুষ: কেন?
নারী: তাহলে বিপত্তি হবে।
পুরুষ: কেন?
নারী: তার ভয় ভাস্কর্য নিয়ে, তিনি চেয়েছেন মৃত্যুর পর সব যেন মুছে যায়।
পুরুষ: তাই কী হয়?
নারী: সে আমি জানি না। লিখেছেন- বাণিজ্য হবে তা নিয়ে, ভাগ হবে রাষ্ট্র আর মন।
পুরুষ: মিথ্যে বলেননি। তাই ব্যবসার সুযোগ দিতে চাননি। কিংবা ভাঙার নামে যে অপমান হবে তার থেকে মুক্তি চেয়েছেন।
নারী: হতে পারে।
পুরুষ: মানুষের সবচেয়ে বড়ো মূর্তি হয় অন্যের মনে।
নারী: লোকটির সাথে আপনার চেহারার মিল আছে।
পুরুষ: চেহারার মিলের সাথে মনের মিল থাকা দরকার। আমাদের সেটা আছে কিনা ভাবছি।
নারী: এমন লোকের সাথে এই সময়ে মনের মিল থাকার দরকার নেই।
পুরুষ: আমাদের সবার আত্মহত্যার সময় চলে এসেছে। আসুন সবাই আত্মহত্যা করি।
নারী: যা বলছেন ভেবে বলছেন তো?
পুরুষ: ঠিক তাই, আত্মহত্যায় মুক্তি আসবে। আসুন মুক্তির জন্য মৃত্যুবরণ করে নেই। সেখানেই সুখ মিলবে। আসুন না সকলে।
নারী: এমন করে ভাবিনি।
পুরুষ: আসুন বেঁচে থাকার দরকারে মৃত্যু টেনে নেই বুকের কাছে।
নারী: বিদায়।
পুরুষ: বিদায়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন