ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সর্বকালের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ২৩ শাসক (পর্ব-২)

রাসেল কবির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সর্বকালের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ২৩ শাসক (পর্ব-২)

রাসেল কবির : একজনের কাছে যিনি নায়ক, অন্যের কাছে তিনিই হতে পারেন স্বৈরাচার এবং অত্যাচারী। ইতিহাসে এমন অসংখ্য নায়ক কিংবা অত্যাচারী স্থান করে নিয়েছেন।

সর্বকালের সবচেয়ে অত্যাচারী ২৫ জন শাসক নিয়ে রাইজিংবিডির তিন পর্বের প্রতিবেদনের আজ ২য় পর্বে ৮ জন শাসকের কথা তুলে ধরা হল।

জার ইভান চতুর্থ (শাসনকাল : মস্কোর গ্রান্ড প্রিন্স হিসেবে ১৫৩৩-১৫৪৭, পুরো রাশিয়ার জার হিসেবে ১৫৪৭-১৫৮৪)

৩৭ বছর রাশিয়ার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন জার চতুর্থ ইভান। নৃশংসতার জন্য ‘ইভান দ্য টেরিবল’ নামেও তিনি পরিচিত। একদিকে যেমন তিনি দেশের সীমানা সম্প্রসারিত করতে পেরেছিলেন, অন্যদিকে তার খামখেয়ালিপনা, নৃশংসতা রাজ্যবাসীকে সারাক্ষণ উদ্বেগে রাখতো। তার নিষ্ঠুরতা থেকে অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূও রেহাই পায়নি এমনকি তিনি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজ পুত্রকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেননি। মানুষের ওপর অত্যাচার করতে পছন্দ করতেন। এসব কারণে মানুষজন যেন পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য শহরের চারপাশে দেয়াল তৈরির আদেশ দিয়েছিলেন।

রানি মেরি প্রথম (শাসনকাল : ১৫৫৩-১৫৫৮)

রাজা অষ্টম হেনরি এবং আরাগনের ক্যাথারিন একমাত্র সন্তান, মেরি ১৫৫৩ সালে ইংল্যান্ডের রানি হয়ে ওঠেন। তিনি প্রোটেষ্টান্ট ধর্মের অসংখ্য অনুসারীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে ‘ব্ল্যাডি মেরি’ নামে কুখ্যাত হন। তার ৬ বছরের শাসনকালটিকে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে মনে করা হয়। তার ৪২ বছরের জীবনটিও ছিল হঠকারী সিদ্ধান্তে পরিপূর্ণ। ৩৬ বছর অবধি অবিবাহিতা থাকার পর স্পেনের যুবরাজ ফিলিপকে বিয়ে করেন এবং স্বামীর নির্দেশে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে ফ্রান্সের কাছে ইংল্যান্ড তার ভূখন্ড হারায়। ইংল্যান্ডের রানি প্রথম মেরি কোনো উত্তারাধিকার না রেখেই মৃত্যু বরণ করেন।

এলিজাবেথ বাথোরি (১৫৯০-১৬১০)

এক নৃশংস সিরিয়াল কিলার হিসেবে ইতিহাসখ্যাত এলিজাবেথ বাথোরি। তার জন্ম ১৫৬০ সালের ১৫ আগস্ট হাঙ্গেরির বিখ্যাত বাথোরি পরিবারে। তার বাবা ছিলেন জর্জ বাথোরি ছিলেন স্টিফেন বাথোথির ভাই। আর স্টিফেন বাথোরি ছিলেন একাধারে কিং অব পোল্যান্ড এবং ডিউক অব ট্রান্সেলভানি। ১৫৭৫ সালের ৮ মে ১৫ বছর বয়সে এলিজাবেথের বিয়ে হয় ফ্রান্স নোডিজডের সঙ্গে পরে যিনি হাঙ্গেরির সেনাপতি নিযুক্ত হন। এলিজাবেথের স্বামী যখন যুদ্ধ থাকতেন তখন ব্যবসা ও শাসন কাজ চালাতেন এলিজাবেথ নিজে। ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের রচয়িতা তিনি। নিজের কালোজাদু এবং যৌবন ধরে রাখার জন্যে এলিজাবেথ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার দুর্গে তরুণীদের ধরে নিয়ে আসতেন। এরপর তাদের রক্তে গোসল করে শয়তানের উপাসনা করতেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এলিজাবেথ প্রায় ৬৫০ জন তরুণীকে হত্যা করেছেন। গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ডে এলিজাবেথ বাথোরিকে সবচেয়ে বেশি ধূর্ত ও বর্বর খুনি নারী বলা হয়েছে। তার হিংস্রতার জন্যে সে সময় তাকে ‘দ্য ব্লাডি কাউন্টেস’ নামে ডাকা হতো। যদিও শেষরক্ষা হয়নি তার। দুর্গে তরুণীদের নিয়ে এসে নৃশংসভাবে খুনের কথা রাজা মেথিয়াস-২ এর কাছে পৌঁছালে তদন্তের পর তার অপরাধ প্রমাণিত হয়। প্রায় ৬৫০ জন তরুণীকে হত্যা করা হলেও মাত্র ৮০ জনকে হত্যার দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সামাজিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে তাকে মৃত্যুদন্ডের না দিয়ে একটি রুমে বন্দী করে রাখা হয়। ১৬১৪ সালের ২১ আগস্ট ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

ম্যাক্সিমিলিয়ন রোবসপিয়ার (শাসনকাল : ১৭৮৯-১৭৯৪)

ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম খলনায়ক জ্যাকোবিন সরকার প্রধান ম্যাক্সিমিলিয়ন রোবসপিয়ারের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের শাসন চলেছিল৷ বিপ্লবকে রক্ষার নামে ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রোবসপিয়ারের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে প্রায় বিনা বিচারে হত্যা করা হয়৷ এর মধ্যে তিনি ৩ হাজার মানুষ গিলেটিনে চড়িয়ে হত্যা করেছিলেন। ১৭৯৪ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং গিলেটিনে চড়িয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

লিওপোল্ড দ্বিতীয় (শাসনকাল : ১৮৬৫-১৯০৯)

বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গোতে নির্দয় শোষণের কারণে অত্যাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত। ১৮৬৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিংহাসনে আরোহন করেন। তার শাসনামলে ১৮৮৫ সালে কঙ্গো কিনে নিয়ে সে দেশের জনগণকে দাসে পরিণত করেন। এখান থেকে তিনি হাতির দাঁত, রাবার এবং অন্যান্য খনিজ দ্রব্য সংগ্রহ করতেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ হাতির বা রাবার সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। তবে তার বাহিনীর অফিসারদের দয়া হলে কুমিরের চামড়ার চাবুক খেয়েই অনেকে বেঁচে যেত। রাবার সংগ্রহের পদ্ধতি ছিল লোমহর্ষক ও নিষ্ঠুরতায় ভরা। রাবার সংগ্রহকারীরা রাবার গাছের জঙ্গলে, গাছের পাতায় ও লতায় লম্বা দা দিয়ে আঘাত করত সেই আঘাতে অনেক সময় তরল রাবার ছিটকে এসে তাদের গায়ে আটকে যেত। এসব রাবার পরে দা কিংবা ছুরি দিয়ে শরীর থেকে উঠানো হতো। উঠানোর সময় বেশিরভাগ সময়ই কঙ্গোবাসীর গায়ের চামড়া পশমসহ উঠে আসত। তার নির্দয় অত্যাচারে কঙ্গোর ৩০ লাখ লোকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কারো কারো মতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এক কোটি, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ। দুর্ভিক্ষ, স্ত্রী-পুরুষ আলাদা থাকা আর হাজার হাজার বিদ্রোহী নিধনের কারণে ১৮৮০ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ এর মধ্যে কঙ্গোর জনসংখ্যা ৫০% হ্রাস পায়।

মুহাম্মদ তালাত পাশা (শাসনকাল : ১৯১৩-১৯১৮)

আর্মেনিয়ান গণহত্যার মূলনায়ক হিসেবে তালাত পাশাকেই ইতিহাসবিদগণ বিশ্বাস করে থাকেন। ১৯০৮ সালে এক বিপ্লবের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট সুলতান আবুল হামিদকে উৎখাত করে ‘ইয়াং টার্ক’ বা ‘তরুণ তুর্কী’ দল ক্ষমতায় আসে। তরুণ তুর্কী দলের শাসনক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন তাদের ‘তিন পাশা’ তালাত পাশা, আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশা। এর মধ্যে সকল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতো তালাত পাশার মাধ্যমে। তরুণ তুর্কী নেতৃবৃন্দ গভীর সংকল্প ও ঘৃণা নিয়ে আর্মেনিয়ান জাতিটিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিযানে নেমে ১৯১৫-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলা আর্মেনিয়ানদের ওপর নৃশংস গণহত্যায় জাতিটির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ১৫ লাখ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শুধু যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডেই তুর্কিদের নৃশংসতা থেমে ছিল তা নয়। শিশুদের হত্যা করে তারা ক্ষান্ত হয়নি, মেয়ে শিশুদের অনেককেই তারা ধর্ষণ করে বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রয় করে দেয়। এই গণহত্যার মূল নকশাকার ও কারিগর ছিল তালাত পাশা।

বেনিতো মুসোলিনি (শাসনকাল : ১৯২২-১৯৪৩)

বেনিতো মুসোলিনি ছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালে ইতালির সর্বাধিনায়ক। ইতালির এই একনায়ক ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৩ সালে তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পুর্ব পর্যন্ত সমগ্র রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ছিলেন। ১৯২২ সালে তিনি রোম অভিযান করে দখলের মাধ্যমে ইতালির ৪০তম প্রধানমন্ত্রী হন। ইটালির রাজা ভিক্টর তৃতীয় ইমানুয়েল বিনা প্রতিবাদে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেন। মুসোলিনি ৭০০০-এর বেশি ইহুদিকে ইতালি থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় ৬০০০ ইহুদিকে পরে হত্যা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের একান্ত বন্ধুতে পরিনত হন মুসোলিনি। ১৯৪৩ সালে সিসিলিতে ক্ষমতাচ্যুত হলে তাকে বন্দী করা হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হিটলারের নির্দেশে জার্মান সেনাদের একটি চৌকশ দল মুক্ত করে মুসোলিনিকে। ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডে পালানোর সময় ইতালির একটি ছোট্ট গ্রামে কমিউনিস্ট প্রতিরোধ বাহিনীর বাহিনীর হাতে ধরা পরেন এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়।

জোসেফ স্টালিন (শাসনকাল : ১৯২২-১৯৫৩)

নির্মমতার দিক থেকে যে সব শাসক ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যো জোসেফ স্টালিন অন্যতম। রুশ ভাষায় ‘স্টালিন’ মানে হচ্ছে ‘লৌহ মানব’। স্টালিন একজন রুশ সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ পশ্চিমারা যাকে প্রচন্ড একগুয়ে, দাম্ভিক, চতুর স্বৈরশাসক উপাধি দিয়েছে সেই তিনি এক নাগারে ৩১ বছর (১৯৪১ সালের ৬ মে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) শাসন করেছেন পুরো সোভিয়েত সাম্রাজ্য। যে সব শাসক ঐতিহাসিকভাবে খ্যাতি পেয়েছেন তাদের মধ্যেই স্টালিন রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহারে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তার আদেশ পালনে লাখ লাখ কৃষককে অভুক্ত রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে কমিউনিস্ট পার্টির শত্রু সন্দেহে বহু মানুষকে হত্যা করেন।

 

পড়ুন : সর্বকালের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ২৩ শাসক (পর্ব-১)

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জানুয়ারি ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়