ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাতক্ষীরার ৩ প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় পুকুর চুরিতে নজর

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫২, ১ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাতক্ষীরার ৩ প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় পুকুর চুরিতে নজর

সাতক্ষীরা মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চমূল্যে যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী ক্রয়ে সাড়ে ২২ কোটি টাকার পুকুর চুরি ধরতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে এগুচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি), মেডিক‌্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ও সাতক্ষীরা মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয়েই ওই দুর্নীতির অভিযোগ।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী ক্রয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ টিমের সমন্বয়ে তদন্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ ও দুদক টিমের সরেজমিন পরিদর্শন চলমান রয়েছে। দুদকের উর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছে।

ফরিদপুর মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালের পর্দাসহ ১৬৬ চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে দুর্নীতির রহস্য উন্মোচনে কাজ শুরুর পরপরই এবার সাতক্ষীরার দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

এ বিষয়ে দুদকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘অভিযোগ অনুসন্ধানে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে নেমেছে ‍দুদক টিম। অনুসন্ধান পর্যায়ে আমরা সংশ্লিষ্ট তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। তাদের রিপোর্ট ও দুদকের নিজস্ব অনুসন্ধান টিমের সরেজমিন অনুসন্ধানের রিপোর্টের ভিত্তিতে শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’

এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর বেশ কিছু নির্দেশনায় চিঠি দিয়েছেন অনুসন্ধান টিম প্রধান দুদক উপপরিচালক মো. সামছুল আলম। নোটিসে বলা হয়, অনুসন্ধানের স্বার্থে ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি), মেডিক‌্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ও সাতক্ষীরা মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে সরবরাহকৃত আসবাবপত্রের মূল্য নিরূপণ করা একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে আপনার অধীনস্থ প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে তাদের নাম, পদবি ও ফোন নম্বর অন্তর্ভুক্ত করে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

চিঠিতে ৩০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটিতে উপস্থিত হয়ে অনুসন্ধান টিমের সদস্য উপ-সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যাচাই ও মূল্য নির্ধারণে সরেজমিনে পরিদর্শন করার কথা উল্লেখ করা হয়। যাচাইকালে সবরাহকারী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিত থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। গঠিত বিশেষজ্ঞ টিমকেও সার্বিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।

অনুসন্ধানের স্বার্থে এর মধ্যে গত ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানগুলোর সাত উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। তারা হলেন-মেডিক‌্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) অধ্যক্ষ ডা. তওহীদুর রহমান ও স্টোর কিপার মামুন-অর-রশীদ, সাতক্ষীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ আকছেদুর রহমান, ডা. মো. আব্দুল লতিফ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. শেখ তৈয়েবুর রহমান, ডা. মো. মেহেদী হাসান ও ঢাকার নিমিউ অ‌্যান্ড টিসির সহকারী প্রকৌশলী এএইচএম আব্দুল কুদ্দুস।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া অভিযোগের বিষয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) ও মেডিক‌্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) নামক দুটি প্রতিষ্ঠানে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ফুটবলের সরকারি ক্রয়মূল্য ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এক থেকে দেড় হাজার টাকার স্টেথোস্কোপ ও বিপি (ব্লাড প্রেসার মাপার) মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ৯ হাজার টাকা। একটি ক্রিকেট ব্যাটের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। এভাবেই সরকারিভাবে উচ্চমূল্যে প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকার খেলার সামগ্রী, বইপত্র, আসবাবপত্র ও স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানসহ হাফ ডজনের বেশি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য উচ্চমূল্যে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কালিগঞ্জের নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) ও মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) নামক দুটি প্রতিষ্ঠানে এসব সামগ্রী ক্রয়ের জন্য গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়। এর মাধ্যমে  ঢাকার উত্তরার মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শাহিনুর রহমান, ঢাকার শ্যামলীর নলতা শরিফ সার্জিক্যালের স্বত্বাধিকারী তরিকুল ইসলাম ও ঢাকার পুরানা পল্টনের মেসার্স ইউনিভার্সাল ট্রেড করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী আসাদুর রহমান দায়িত্ব পান। যেখানে মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন ম্যাটস ও আইএইচটির তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, কমিটির সদস্য ডা. আকছেদুর রহমান, ডা. আব্দুল লতিফ, শেখ আব্দুল আলিম, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান, আরএমও কালিগঞ্জ ডা. শেখ তৈয়েবুর রহমান ও দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মেহেদি হাসান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজ চার কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭২০ টাকার খেলার সামগ্রী ও আসবাবপত্র সরবরাহের দায়িত্ব পায়। নলতা ম্যাটসে দুই কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮১০ টাকার এবং আইএইচটিতে দুই কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯১০ টাকার আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী সরবরাহ করে তারা। তবে মোট টাকার মধ্যে ৭৬ লাখ ৫১ হাজার ৬৬০ টাকার ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি নিট বিল পায় তিন কোটি ৭৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬০ টাকা।

একইভাবে নলতা শরিফ সার্জিক্যাল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তরিকুল ইসলাম মোট ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার ২৫ টাকার বইপত্র সরবরাহ করেন। এর মধ্যে ম্যাটসে ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯৩ টাকার এবং আইএইচটিতে ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৩২ টাকার বইপত্র রয়েছে। ঠিকাদারি এই প্রতিষ্ঠান চার লাখ ৪৯ হাজার ৭৩৪ টাকা সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রদান করে।

এ ছাড়া ঢাকার পুরানা পল্টনের মেসার্স ইউনিভার্সাল ট্রেড করপোরেশন, কালিগঞ্জের নলতা ম্যাটস ও আইএইচটিতে মোট ১৭ কোটি ৪৯ লাখ ২৪ হাজার ১৬৪ টাকার বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করে। এর মধ্যে ম্যাটসে ৭ কোটি ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৬৫০ টাকার এবং আইএইচটিতে ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫১৪ টাকার স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য সামগ্রী রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ও ট্যাক্স দেয় দুই কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার ৯০৫ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শাহিনুর রহমানের বিরুদ্ধে। তার প্রতিষ্ঠান ম্যাটস ও আইএইচটিতে  ২০টি ফুটবল এক লাখ টাকা, ক্রিকেট ব্যাট ৫০টি সাড়ে সাত লাখ টাকা, এছাড়া ক্রিকেট বল, প্যাড, হেলমেট, গ্লাবস, ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ অন্যান্য খেলার বিভিন্ন ধরনের ৫৮টি সামগ্রী সরবারহ করে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ টেবিল প্রতিটি ৮০ হাজার ৫০০ টাকা, হাফ সেক্রেটারি টেবিল ৪৯ হাজার ৩০০ টাকা, স্টিল আলমিরা ৪০ হাজার ৭০০ টাকায় ১০টি, গ্লাস আলমিরা ৪০ হাজার ৭০০ টাকায় ১০টি, স্টিল ফাইল কেবিনেট ২৮ হাজার ৫৫০ টাকায় ১৫টি সরবরাহ করে।

**



ঢাকা/এম এ রহমান/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়