ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ভাইরাসে মরছে ‘সাদা সোনা’

এম.শাহীন গোলদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৫, ২২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাইরাসে মরছে ‘সাদা সোনা’

এম. শাহীন গোলদার, সাতক্ষীরা থেকে : ভাইরাস সংক্রমণ ও প্রখর সূর্যতাপের কারণে মারা যাচ্ছে সাতক্ষীরার সাদা সোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ি।

জেলার চিংড়ি ঘেরগুলোতে এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে চিংড়ি চাষিদের। এ সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে চাষিরা বাগদা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে ৫৪ হাজার ৯৩৫টি ঘের রয়েছে। জেলায় এ বছর ৬৬ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। গত বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। তবে উৎপাদন হয়েছিল ২৬ হাজার ৮০০ মেট্রিন টন।

সাধারণত ৮ থেকে ১৪ পিপিটি (পার্টস পার থাউজেন্ড) লবণাক্ত পানি বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী। একটানা প্রখর সূর্যতাপের কারণে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি। গতবছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখানে মাছের ঘের সনাতন পদ্ধতির। অধিকাংশ ঘেরে পানির গভীরতা দেড় থেকে দুই ফুটের বেশি নয়।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের চিংড়ি চাষি ইমদাদুল হক ও ফজলুল হক ফজলু জানান, জেলার আইলা দুর্গত শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া, রায়মঙ্গল, কপোতাক্ষ ও কালিন্দি নদীর উপকূলবর্তী এলাকায় চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি।

এ ছাড়াও কালীগঞ্জ, দেবহাটা, সাতক্ষীরা সদর, তালা ও কলারোয়া উপজেলার কপোতাক্ষ, কাঁকশিয়ালী, বেতনা নদীর দুই তীরের এলাকায় চিংড়ি চাষ একেবারে কম নয়। এ সব এলাকায় চিংড়ি চাষের জন্য এক বিঘা জমি লিজ নিতে হয় প্রতি বছরের জন্য ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকায়। মৌসুমের  শুরুতে চট্টগ্রাম, কলাতলী ও কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন হ্যাচারির সরবরাহকৃত রেণু ঘেরে ছাড়া হয়। তবে অনেকেই দ্বিতীয় গ্রেডের হ্যাচারির রেণু ব্যবহার করে থাকে। ঘেরে রেণু পোনা ছাড়ার আগে যথাযথভাবে তার গুণগত মান পরীক্ষা করা হয় না।

লবণাক্ত পানিতে বাগদা চিংড়ির পাশাপাশি মিঠা পানিতে গলদা চিংড়ির চাষও হয়ে থাকে। এবার এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রচণ্ড সূর্যতাপ ও দাবদাহে পানির লবণাক্ততা বাড়তে শুরু করে। একই সঙ্গে পানি গরম হয়ে চিংড়িতে ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।

তারা আরো জানান, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঘেরে বাগদা চিংড়ি ধরা শুরু হয়। এ সময় কয়েকটি ঘেরের পানিতে অজানা ভাইরাসের কারণে বাগদা মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। ভাইরাস সংক্রমণ এবং ঘেরের পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধিই চিংড়ি মড়কের কারণ বলে তারা মনে করেন।

চাষিরা জানান, বর্তমানে বিভিন্ন ঘেরের চিংড়ি মরে উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ছোট অবস্থাতেই চিংড়ি ধরতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। আর ছোট চিংড়ি ধরার কারণে তা বিদেশে পাঠানোর জন্য মাছের সেডে বিক্রি হচ্ছে না। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি ৪০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

আধুনিক পদ্ধতিতে সরকারিভাবে চিংড়ি চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের আবারো সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন অভিজ্ঞরা।

আশাশুনি উপজেলার দরগাহপুর গ্রামের চিংড়ি ব্যবসায়ী মো. বিপ্লব মোড়ল জানান, প্রতি বছর এ সময় তার সেডে ২০ থেকে ২৫ মণ চিংড়ি কেনা বেচা হতো। গত এক মাস যাবৎ প্রতিদিন দুই মণ মাছ বেচা কেনাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় তাদের কর্মচারিদের বেতন দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

চিংড়ি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা মশিউর রহমান পলাশ বলেন, ‘গত বছর বাংলাদেশ প্রথম বারের মত এই ভাইরাস দেখা দেয়। এটি প্রথম ধরা পড়ে ২০০৯ সালে চীনে; ২০১০ সালে ভিয়েতনামে, ১১ সালে ইন্দোনেশিয়ায়, ১২ সালে থাইলান্ডে ও ২০১৩ সালে ভারতে।এরপর ২০১৬ সালের দিকে আমাদের দেশে ধরা পড়ে। এই ভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মূলত ভারত থেকে আসা নিম্নমানের ডিম ও পোনা (নাপলি) আমদানির কারণে।

তিনি মাছের এই ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি হলে, লবনাক্ত পানিতে হাইড্রোজেনের কার্যকারিতা অর্থাৎ পটেনশিয়াল হাইড্রোজেন (পিএইচ) ৮৫ এর উপরে গেলে, পুকুরের তলায় অধিক মাত্রায় কালো মাটি জমা হলে ও খামার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি হলে মাছ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।

 



এ রোগের লক্ষণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, পোনা ছাড়ার ৩০ দিন থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ছোট চিংড়ি মাছ মারা যায় এবং এর খাদ্যনালী আংশিক খালি পাওয়া যায়।

চিংড়ি চাষে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চিংড়িতে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে যখন ঘেরে রোগ ধরা পড়ে তখন সেই ঘের মালিক কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা না বলে ঘেরের পানি সেচে ফেলে দেন। এতে সেই পানি কোন না কোনভাবে অন্য ঘেরে চলে যায়। তবে শুধু যে ভাইরাসের কারণেই ঘেরে চিংড়ি মারা যাচ্ছে এমন অভিযোগ ঠিক নয়। সনাতন পদ্ধতিতে এখনো ঘের পরিচালনা করায় পরিচর্যা সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে চিংড়ির খাদ্য হিসেবে ঘেরে প্রয়োজনীয় উপাদান (ফাইটো পাঙ্কটন ও জুপাটন) তৈরি হয় না। পানির গভীরতা কম থাকায় প্রখর সূর্যালোকে মাছ মারা যাচ্ছে। তাছাড়া হ্যাচারিতে ১০ পিপিটি লবণাক্ততার পানিতে রেণু উৎপাদনের পর তা পরিশোধন না করে রেণু ছাড়া হয় যে কোনো পিপিটিযুক্ত পানিতে। এতে নতুন পানির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে চিংড়ি এক মাস না যেতেই মারা যাচ্ছে। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাপর পদ্ধতিতে চিংড়ি রেণুকে বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড় প্রতিরোধে শক্তিশালী না করতে পারাটাও চিংড়ি মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

স্থানীয়রা বলছেন, সাতক্ষীরার অর্থনীতি চিংড়ি নির্ভর। এটাকে বাঁচাতে হলে চাষিদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে ঘের তৈরি করে এতে উন্নতমানের রেণু পোনা ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে বাগদা ও গলদা চিংড়ির এক তৃতীয়াংশ উৎপাদিত হয় সাতক্ষীরা জেলায়। এখানে শুধু বাগদা ও গলদা নয়; রুই,  তেলাপিয়া ও অন্য মাছও উৎপাদন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাগদা চিংড়ির বিশেষ সমস্যা হয়ে থাকে। বাগদা চিংড়ির ঘেরে পানির গভীরতা তিন ফুট বা এক মিটার রাখার জন্য চাষিদের পরামর্শ দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তা মানেন না। ফলে প্রখর সূর্যালোকের কারণে স্বল্প গভীর ঘেরের তলদেশ থেকে এমোনিয়াম সালফেট পানিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে মাছ মরে যেতে পারে। ছত্রাকের কারণে চিংড়ি মারা গেলেও এবার মড়ক লাগার অন্যতম কারণ হলো ভাইরাস। এ ছাড়া ১৯৯৪ সাল থেকে বাগদা মাছে ভাইরাস লেগে আছে। এটি বন্ধ করার কোনো ওষুধ আমাদের কাছে নেই। এটা নিয়েই চাষ করতে হবে।’



রাইজিংবিডি/সাতক্ষীরা/২২ এপ্রিল ২০১৭/এম. শাহীন গোলদার/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়