ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সুধীন দাশ ও রাগ পুরবী

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুধীন দাশ ও রাগ পুরবী

সুধীন দাশ

খান মোঃ শাহনেওয়াজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছাত্র কেন্দ্রের (টিএসসি) দ্বিতীয় তলায় বড় হলরুমে আয়োজন করা হয়েছে ঢাকা জেলা রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতা। রুমের পূর্ব দিকের দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে মঞ্চ। এই মঞ্চের সরাসরি সামনে পশ্চিম পাশে বিচারকদের আসন। বিচারকদের একজন দেশের খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও সংগীত গুণীজন ড. সনজিদা খাতুন।

১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানস্থলে প্রতিযোগী ও তাদের স্বজনরা ছাড়াও সংগীত প্রেমী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শ্রোতা-দর্শকদের বেশ সমাগম ঘটেছে। একটু ভিড় ভিড় অবস্থা। রাজধানী ঢাকা নগরীর বেশির ভাগ গানের স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা এসেছে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। ঢাকার বিভিন্ন উপজেলা পর্যায় থেকেও প্রতিযোগীরা এসেছে। প্রতিযোগীকে নির্ধারিত কয়েকটি গানের তালিকা থেকে একটি এবং নিজের পছন্দ অনুযায়ী একটি গান গাইতে হবে।

সকাল ১০টায় নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা। একেকজনের মন মাতানো পরিবেশনা। গান শুরু হওয়া মাত্র পিনপতন নিরবতা। অনুষ্ঠানস্থলে দেখা গেল অনেক গুণী শিল্পীকে। এলেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অজিত রায়। তাকে দেখে গানের ফাঁকে ড. সনজিদা খাতুন জোরে নাম ধরে ডাকলেন, ‘অজিত, এখানে আয়।’

আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো বিস্ময়। ছাই রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি আর সাদা সুতির পাজামা পড়া একজন এলেন, পরিচ্ছন্ন চেহারা। গানের ফাঁকে একজন গিয়ে ড. সনজিদা খাতুনের কানের কাছে কিছু বললেন। ড. সনজিদা খাতুন ও অজিত রায় উঠে দাঁড়ালেন এবং এগিয়ে এসে তাকে নমস্কার জানিয়ে একেবারে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বিচারকদের চেয়ারের কাছে বসালেন। উপস্থিত সংগীত গুণীজন সবাই দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানালেন। আমার সংগীত বিদ্যায়তন ছায়ানটের সহশিক্ষার্থী একজন আমাকে বললেন, ইনি সংগীত গুরু সুধীন দাস।

এই প্রথম আমি সুধীন দাসকে (জন্ম ৩০ এপ্রিল, ১৯৩০ - মৃত্যু ২৭ জুন, ২০১৭) সামনে থেকে দেখলাম, আমি এক কিংবদন্তীকে দেখলাম।

তার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। রেডিওতে তার কণ্ঠে কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান শুনেছি। আমার খুব আগ্রহ হলো তার সঙ্গে একবার কথা বলার। অনুষ্ঠান শেষে সে সুযোগ এসে গেল। টিএসসি ভবনের বাইরে তাকে পেয়ে এগিয়ে গেলাম। একজন দারুন মানুষ, বিনয়ী এবং বৎসল। তিনি হয়ে গেলেন সুধীন দা।

এরপর তার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে বাংলাদেশ বেতারের আগারগাঁও অফিসের সামনে বা করিডরে। তিনি যেতেন গানের রেকর্ডিংয়ে আর আমি যেতাম অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি (স্ক্রিপ্ট) জমা দিতে বা কথিকা রেকর্ডিংয়ে। এই করেই একবার সুযোগ হলো একেবারে তার সামনে বসে তার কণ্ঠে গান শোনার। নজরুল সংগীত শিল্পী ও খিলগাঁওয়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদ সংগীত একাডেমির শিক্ষক সাধন চন্দ্র বর্মনের নিজের পরিচালিত গানের স্কুলে। সাধন চন্দ্র বর্মন টি অ্যান্ড টিতে চাকরি করতেন, রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডায় থাকতেন এবং বাড্ডায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় একটা গানের স্কুল চালাতেন। সাধন চন্দ্র বর্মনের গানের স্কুলটি ভাড়া বাসা থেকে এক পর্যায়ে বাড্ডা আলাতুননেসা স্কুল ভবনে স্থান পায়। সুধীন দা গিয়েছিলেন বাড্ডা আলাতুননেসা স্কুলে এই সংগীত একাডেমিতে।

সেদিন সন্ধ্যার পর সুধীন দা হারমোনিয়াম বাজিয়ে কণ্ঠে ধরেন পুরবী রাগে খেয়াল। পোক্ত কণ্ঠ, পরিচ্ছন্ন গায়কী। বসে যাওয়া সন্ধ্যায় তার কণ্ঠে রাগ পুরবী পুরো পরিবেশকে আবিষ্ট করে ফেলে। ত্রিতাল মধ্য লয়ে তিনি গাইছিলেন খেয়াল যার বন্দেশ- পার কর মোপে আব তুম নিজামী / পীরানে ফির তুম রহমত কামী / সারি জাহান মে পীর তুমি হো / বকশানেওয়ালা তুঁহি সবনকো / কুতুব আউলিয়া চহুঁ চোক মে তুহারী ধুমী।।

আলম-পিয়া রচিত এই বন্দেশটি আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ার কারণে সুধীন দা’র সুর অনেক বেশি অন্তর ছুঁয়ে গেছে, যা আজও আমার কানে লেগে আছে। সেদিন সুধীন দার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন সেই সময়ের উদীয়মান তবলাবাদক সমর পাল। সিরাজগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে তবলায় শিক্ষা নেওয়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঘরানায় তালিম পাওয়া সমর পালের হাতের আঙুল সেদিন বায়া-তবলায় নৃত্য করেছে। ঠেকা-তেহাই সুস্পষ্ট বোল তুলেছে। তবলার বোলের সঙ্গে সুধীন দার বোলতান, গমক, বিস্তার অসাধারণ প্রকাশ ঘটিয়েছে।

পুর্ব্বী বা পুরবী ঠাটের আশ্রিত রাগ পুরবী হচ্ছে সন্ধিপ্রকাশ রাগ বা সন্ধ্যাকালের রাগ। সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই রাগে খেয়াল ধরেছিলেন সুধীন দা। সেদিন সুন্দর সন্ধ্যার মেজাজ অনুযায়ী তিনি ঢেলে দিয়েছেন সুর। নজরুলগীতি গাইলেও তিনি ছিলেন মূলত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী। রাগের চলনে তার ছিলো সাবলীল প্রকাশ। পূর্বাঙ্গ-প্রবল সম্পূর্ণ জাতীয় রাগ পুরবী সম্পর্কে দুটি কথা বলে তিনি শুরু করেছিলেন সুরের আলাপ।

এই গুণী কণ্ঠশিল্পী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, যা দেশের সঙ্গীতাঙ্গনের জন্য অপুরণীয় ক্ষতি। তার সান্নিধ্য যতটুকুই পেয়েছি তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা গেছে যে, দেশের সঙ্গীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে তার প্রবল আগ্রহ ছিলো, চিন্তা ছিলো এবং প্রচেষ্টা ছিলো। তিনি ভাবতেন শুদ্ধ সংগীতের কথা। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে আগারগাঁও রেডিও অফিসে এক আড্ডায় তিনি বলেছিলেন, বাউল শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো এলোমোলো হয়ে যাচ্ছে। সেগুলোকে একটা ফ্রেমে নিয়ে আসা দরকার।

সংগীতের জন্য তিনি যা করেছেন তা চিরস্মরণীয়। কিন্তু তার আরো অনেকদিন বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিলো, দেশের অনেক অরক্ষিত গান ও সুরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই তাকে প্রয়োজন ছিলো। তিনি চলে গেছেন, তার কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তার সহচর্য যারা পেয়েছেন সেই স্নেহধন্য সংগীত গুণীজনরা তার অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করার জন্য এগিয়ে আসবেন- এটাই প্রত্যাশা।

 


 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/ জুলাই ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়