ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সুন্দর পৃথিবীর জন্য গবেষণা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৮, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুন্দর পৃথিবীর জন্য গবেষণা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : কেউ গবেষণা করছেন ক্যাম্পাসের ছাত্রীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে চ্যালেঞ্জ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্জ্য নিয়ে, কেউ গবেষণা করছেন ময়লা ও পানি ব্যবস্থাপনা, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে। কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের ওপর ফেসবুকের প্রভাব, ক্যাম্পাসে শব্দদূষণ, যানজট, ক্যাম্পাসের স্ট্রিট ফুড, টিএসসির সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস নিয়ে। এছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে টিম বিভক্ত হয়ে গবেষণা কাজ পরিচালনা করছে ওরা।

সুন্দর পৃথিবীর জন্য গবেষণা’ বা ‘রিসার্চ ফর এ বেটার ওয়ার্ল্ড’। এ স্লোগান নিয়ে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রথম গবেষণা সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ’। নিয়মিত বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ছাত্রছাত্রীদের একাডেমিক গবেষণায় সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি পেশা হিসেবে গবেষণা ক্যারিয়ার গ্রহণে উৎসাহ ও সহযোগিতা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ (Dhaka Univeesity Research Society-DURS)।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাস বিভাগের এমফিল গবেষক সভাপতি সাইফুল্লা সাদেক বলেন, ‘সারা বিশ্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ে এগিয়ে নিতে কাজ করা, গবেষণার মাধ্যমে উদার, যৌক্তিক, অসাম্প্রদায়িক ও চিন্তাশীল প্রজন্ম তৈরিতে ভূমিকা রাখা, সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা উদ্বদ্ধু করার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী বিনিমার্ণে কাজ করা এ সংগঠনটির মূল লক্ষ্য।’

সংগঠনের শুরুর গল্পটি বলতে সাইফুল্লাহ সাদেক জানান, ‘সাংবাদিকতা ও টিএসসিকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে রিসার্চ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ জাগে তার মধ্যে। তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের অনুমতিক্রমে এবং বিভিন্ন বিভাগের গবেষণামনস্ক প্রায় ৩৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।’

গবেষণা সংসদের প্রতিষ্ঠার অল্প কদিন পরই সংগঠনটি গবেষণা ক্যারিয়ারকে ফোকাস করে আয়োজন করে দিনব্যাপী প্রোগ্রাম। ‘এ ক্যান্ডিড জার্নি টু রিসার্চ’ তথা ‘গবেষণার সহজ-সরল যাত্রা’ শিরোনামের প্রোগ্রামে ‘গবেষণার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার আছে’-এ মূল ভাবকে গুরুত্ব দিয়ে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও গণমাধ্যম বিষয়ে গবেষণা কেমন হতে পারে সে বিষয়ে প্রত্যেক সেক্টর থেকে বিজ্ঞ গবেষকরা আলোচনায় অংশ নেন। এ অনুষ্ঠানে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এরপর সদস্য আহ্বান করে গবেষণা সংসদ। ৭০০ ছাত্রছাত্রী আবেদন করে, সেখান থেকে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ৪৭০ জনকে সদস্য হিসেবে নেয়া হয়।

গবেষণা সংসদে রয়েছে দুটি কেন্দ্রীয় গবেষণা টিম ও ১৮টি বিশেষায়িত গবেষণা টিম। টিমগুলো হলো যেমন-এডুকেশন, সায়েন্স, বায়ো-সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, আইসিটি, আর্থ অ্যান্ড এনভায়রন্টমেন্ট, অর্থনীতি, বিজনেস ট্রেড অ্যান্ড ট্যুরিজম, ইতিহাস, অর্থনীতি, পলিটিকস, ল অ্যান্ড লিগ্যাল সিস্টেম, সোশ্যাল সায়েন্স, হিউমেনিটিস, ইথিকস অ্যান্ড রিলিজিয়ন, আর্ট অ্যান্ড কালচার, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স, জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং এনথ্রোপলোজি গবেষণা টিম। মৌখিক পরীক্ষার সময় সদস্যরা নিজ নিজ পছন্দের টিম বাছাই করার সুযোগ পায়।  প্রত্যেকটি টিমে সদস্যদের মধ্য থেকে বাছাইকৃত একজনকে সমন্বয়ক নির্বাচিত করা হয়। প্রত্যেক টিমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের একজন করে শিক্ষক সুপারভাইজার হিসেবে আছেন এবং তারা ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা নিয়ে সার্বিক সহযোগিতা, পরামর্শদান করে যাচ্ছেন।

শুরু থেকে সংগঠনটি ব্যতিক্রম সব উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে বছরব্যাপী ব্যতিক্রধর্মী কর্মসূচি হলো ‘মিট দ্য রিসার্চার’। ১ মাস পরপর একটি করে সেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি সেশনে আলোচক হিসেবে থাকেন দেশ/বিদেশের বিশিষ্ট গবেষক। এটি মূলত গবেষণার ওপর উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠান, যেখানে নানা প্রশ্নের উত্তর জেনে নেয়ার সুযোগ থাকে। এই আয়োজন একজন তরুণের মধ্যে গবেষণাকে ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করার মনোভাব তৈরি করে। এখন পর্যন্ত ৪টি মিট দ্য রিসার্চার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ছাত্রছাত্রীদের গবেষণায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সাপ্তাহিক ফ্রি ওয়ার্কশপ পরিচালনা করে থাকে গবেষণা সংসদ। সপ্তাহের প্রতি শনিবার এই সেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি সেশনে একজন করে বিশেষজ্ঞ গবেষক এসে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে গবেষণার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বক্তব্য রাখেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১টি সাপ্তাহিক ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছে গবেষণা সংসদ।

নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সংগঠনটি এগিয়ে নিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। তবে বছরের মাঝামাঝি এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংগঠনটিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটভুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ। এখন ছাত্রছাত্রীদের অন্যান্য সংগঠনের মতোই ডিইউআরএস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বীকৃত সংগঠন।

সংগঠনের সহ-সভাপতি রোমানা পাপড়ি জানান, গবেষণা সংসদ গবেষণা জার্নাল প্রকাশ করবে শিগগিরই। ইংরেজি এবং বাংলা; বছরে দুটি গবেষণা জার্নাল প্রকাশ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সংগঠনটি।

গবেষণা সংসদের অন্যতম লক্ষ্যের মধ্যে আছে, দেশবিদেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণা কাজ করা। সে লক্ষে শুরু থেকে সংগঠনটি কাজ শুরু করে। টিম অ্যাসোসিয়েটস, ম্যাগনাম কনসালটেন্ট, সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস (কারাস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে গবেষণা কাজে অংশ নেয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি শিল্পকলা চর্চার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার জন্য প্রস্তাব করেছে গবেষণা সংসদকে। ভারতের এলসিভিআর এর সঙ্গে গবেষণা সংসদ নানা কর্মসূচি গ্রহণে কথা হয়েছে।

সংগঠনের বিভিন্ন সদস্য এটুআই, বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ সহ বিভিন্ন গবেষণা সেন্টার ও প্রতিষ্ঠানের হয়ে গবেষণা ক্যারিয়ারও করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বে পরিচালিত সংগঠনটি আর কদিন পরই পূর্ণ করবে এক বছর। নিজেদের সংগঠন প্রতিষ্ঠার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে তরুণ গবেষকরা। এদিন সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে নানা কর্মযজ্ঞ। গবেষণা সংসদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে শুরু হবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি।

গবেষণা সংসদের কার্যক্রম সম্পর্কে সভাপতি সাইফুল্লাহ সাদেক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যেকোনো নতুন আইডিয়া বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ থাকে, নানাবিধ বাধা থাকে, সীমাবদ্ধতা থাকে। গবেষণা সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবু আমরা পেছনে ফিরে তাকাইনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমরা ঋণী। কাজেই কিছু দেয়ার আছে। ভেবেছি, সময় দ্রুত চলে যায়। দেয়ার সময় পাবো কিনা ঠিক নেই। তাই যখনই সুযোগ পেয়েছি নিজেদের চিন্তাগুলো বাস্তবায়ন করে ভবিষ্যতে প্রজন্মের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছি। তাই অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের প্রচেষ্টায় আমরা এই কাজ শুরু করেছি।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি করা। সেই জ্ঞানকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। এভাবে একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। গবেষণা সংসদও সেই লক্ষ্যে কাজ করছে। একটি প্রতিষ্ঠানের সকল অঙ্গকে কাজ করতে হয়, নয়তো তা ফলপ্রসু হয় না। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯শ’ শিক্ষক যেমন গবেষণা করবেন তেমনি ৩৭ হাজার ছাত্রছাত্রীকেও গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে হবে বা গবেষণায় আগ্রহী করতে হবে। তবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে তুলনা করা যাবে। আমরা বিশ্বাস করি, একমাত্র গবেষণা পারে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করতে, একটি সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণ করতে।’ টেকসই উন্নয়নের জন্য সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণার বিকল্প নেই।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মকছুদুল করিম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বিবেচনার গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো গবেষণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে অনেক দূরে আছে। অনেক গবেষণা সেন্টার থাকলেও শিক্ষার্থীদের গবেষণায় সচেতন করতে কোন প্লাটফর্ম ছিল না। মূলত শিক্ষার্থীদের গবেষণার একটি প্লাটফর্মের অভাববোধ থেকেই এই সোসাইটিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ডিসেম্বর ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়