স্কুটিতেই সচল শাহানাজের সংসারের চাকা
জীবনের সঙ্গে সংগ্রামটা তার শুরু ছোটবেলাতেই। শত বাধা-বিপত্তির পরও সাহসের সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে চলছেন। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে ধরেছেন স্কুটির হাতল। সে সফলতায় হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয় ‘স্কুটি আপা’।
স্কুটি চালানোর পাশাপাশি তিনি এখন একজন প্রশিক্ষকও। আর এতেই দুই মেয়ে ও মাকে নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছে তার সংসার।
বলছি ‘স্কুটি আপা’ নামে পরিচিতি পাওয়া শাহানাজ আক্তার পুতুলের কথা। ৮ মার্চ (রোববার) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। আলোচনায় তিনি জানালেন নিজের জীবন-সংগ্রামের কথা। উঠে আসে পথ চলতে গিয়ে তার সমস্যার কথাও। অবশ্য সংসারের একমাত্র অবলম্বন স্কুটি চুরির পর তা ফিরে পেতে সাংবাদিক ও পুলিশ যেভাবে তাকে সহযোগিতা করেছে সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভোলেননি তিনি।
শাহানাজ আক্তার পুতুলের ভাষ্যে, ‘লেখাপড়া শেষ করে সংসার জীবনে প্রবেশের পর বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে কোনোরকমে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়ে দুটি যখন বড় হচ্ছিল তখন অস্থির হয়ে উঠি। কীভাবে তাদের মানুষ করবো। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। সিদ্ধান্ত নেই ‘কিছু একটা’ করতে হবে। সেই কিছু একটা করার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি স্কুটি চালানোর শখ ও জীবিকার তাগিদ নিয়েই যন্ত্রচালিত দ্বিচক্রযানের হাত ধরা। সড়কে প্রথম প্রথম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও এখন অনেকটা স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, ‘মিরপুর বাংলা কলেজে বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। তাদের পড়াশোনার পেছনে মাসে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। খরচ জোগাতে এবং একটু ভালো থাকতে স্কুটি চালানো শুরু করি। প্রথমে অনেকে অনেক কথা বলেছে, কটূক্তি, ব্যঙ্গও করেছে। অন্যের কথা শুনে আমার কি হবে, তারাতো আমাকে এক প্লেট ভাতও দেয় না। নিজেরটা নিজেরই করে খেতে হচ্ছে।’
স্কুটি কিনতে গিয়েও তাকে বিপত্তিতে পড়তে হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বোনদের কাছ থেকে টাকা ঋণ, নিজের কিছু জমানো টাকা এবং ধার-দেনা করে এক লাখ ৫৮ হাজার টাকা দিয়ে স্কুটি কিনি। তাতে ভালোই চলছিল। কিন্তু একজনকে বিশ্বাস করে।হঠাৎ প্রতারণার শিকার হই। চুরি হয় আমার শখের স্কুটি। তখন অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে সাংবাদিক, পুলিশের সহযোগিতায় স্কুটি ফিরে পাই।
কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘স্কুটি আপা’ বলেন, ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ শেষ করি। বড় মেয়ের ক্লাস শুরু সকাল ৮টায়। তাকে স্কুলে দিয়ে এসে আবার বাসার কাজে হাত লাগাই। বেলা ১২টায় ছোট মেয়ের স্কুল শুরু হয়। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসি, এসময় বড় মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসি। দুপুর ২টার দিকে ছোট মেয়ের স্কুল শেষ হয়। চেষ্টা করি তাকেও বাসায় পৌঁছে দিতে। তবে এর মাঝে দূরের ট্রিপে গেলে মাঝে-মধ্যে সেটা হয়ে ওঠে না।
আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছি জানিয়ে শাহানাজ বলেন, আগে যারা আমার যাত্রী ছিল তারা অনেকে এখন আমার কাছ থেকে স্কুটি চালানো শিখছে। সেখানে তাদের একঘণ্টা ট্রেনিং দেওয়া হয়। মা আমার সঙ্গেই থাকেন। কিছু টাকা লোন নিয়ে তাকে একটা টং দোকান করে দিয়েছি। মা-মেয়ে মিলে একটু ভালো থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
স্কুটি চুরির ঘটনায় দায়ের করা মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহানাজ বলেন, আমার মতো একজন অসহায় নারীর স্কুটি চুরি করতে একটু বিবেক নাড়া দিলো না। তার (চোর) এটুকু বোঝা উচিত ছিল, একজন মেয়ে কতটুকু অসহায় হলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরও সংসার চালাতে স্কুটি নিয়ে রাস্তায় বের হয়। আমি তার বিচার চাই। যা দেখে আর কেউ যেন এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।
ঢাকা/মামুন খান/জনি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন