ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

স্ত্রী উত‌্যক্তের প্রতিবাদ করে মোবাইল চুরির আসামি!

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৬, ১১ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্ত্রী উত‌্যক্তের প্রতিবাদ করে মোবাইল চুরির আসামি!

ঢাকা সিএমএম আদালতে কতই না ঘটনা ঘটে প্রতিদিন। আসামি, সাক্ষী আর আইনজীবীদের চেষ্টা-তদবির আর কষ্টের চিত্রনাট্য রচিত হয় ক্ষণে ক্ষণে। কিন্তু অসহায় মানুষগুলো নির্মম দৃশ্য দেখেও চুপ করে থাকেন। তেমনি একটি ঘটনার সাক্ষী এই প্রতিবেদক।

সময়টা বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২ টা। মোবাইল চুরির মামলায় গ্রেপ্তারকৃত রহিম নামের এক যুবক শরীরের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন আদালতের বারান্দায়। ঠিকমত বসা কিংবা দঁড়ানো তো দূরে থাক, কথাও বলতে পারছিলেন না। চোখের পানি টল মল করছে। কাছে গিয়ে তার দিকে তাকাতেই অঝোরেই কেঁদে ফেলেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হওয়ায় হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন স্বজনদের। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, একজন রহিমের স্ত্রী এবং অন্যজন বোন।

জানা যায়, রহিম সাধারণ শ্রমিক। বিয়ে করেন এক পোষাক শ্রমিককে। সুখে-দু:খে দিন যাচ্ছিল তাদের। সংসারে দুটি সন্তানও আছে। নিজেরা তেমন শিক্ষিত না হলেও দুই সন্তানকে ভাল মানুষ হিসেবে গড়ার জন্য বাসা ভাড়া নেন রাজধানীর পল্লবীতে। কিন্তু তাদের সুখের সংসারে হানা দেয় বখাটেদের কুনজর। রহিমের স্ত্রীকে কাজে আসা-যাওয়ার পথে উত‌্যক্ত করতো ওই এলাকার বখাটে নলিতা বাবু এবং সানী। রহিম বারবার তাদের বুঝিয়েছেন, এতে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ঘটনার এক পর্যায়ে কাজ শেষে ফেরার পথে দুই বখাটেসহ ৫/৬ জন রহিমকে নির্মমভাবে মারধর করে। এতে বাম হাত ভেঙে যায় এবং ইট দিয়ে থেঁতলানোয় মাথার পিছনের অংশে তিনটি সেলাই দিতে হয়।

এরপর তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। পরে এলাকার লোকজন এগিয়ে আসলে বখাটেরা কৌশলে তার পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে দেয়। এরপর মোবাইল চোর হিসেবে আরেক দফা মারধর করে তার কাছে থাকা চার হাজার টাকা এবং একটি মোবাইল সেট নিয়ে চলে যায়।

এ প্রসঙ্গে মো. রহিম জানান, ‘আমার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ওরা আমাকে অনেক মেরেছে। আমি বাঁচতে চাই। ওরা সন্ত্রাসী, বড় ধরণের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে রহিম জানান, আমি কিছুই চুরি করিনি। বরং আমার পকেটে থাকা ৪ হাজার টাকা ও লাভা স্মার্ট ফোন তারা নিয়ে গেছে। মারধর করার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে শুনি, ওরা নাকি আমার পকেটে মোবাইল ফোন পেয়েছে। সেটা নিয়ে আমি নাকি কোন বাসার তিন তলা থেকে লাফ দিয়েছি। অথচ মোবাইল চুরির প্রশ্নই আসে না, বরং আমার টাকাসহ মোবাইল নিয়ে গেছে বখাটেরা। যদি লাফ দিতাম, তাহলে আমার পায়ে সমস্যা হতো, ঘাড়ে ব্যথা পেতাম না। ওরা আমাকে ইট দিয়ে ঘাড়ে আঘাত করেছে।’

ভিকটিম রহিমের বোন জাহানারা বেগম জানান, ‘আমার ভাইকে মিথ্যা অভিযোগের মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মোবাইল চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা, বানোয়াট। আমার ভাই দিনমজুর।’

রহিমের ভাগ্নে নূর ইসলাম জানান, আমার মামী গার্মেন্টসে কাজ করতো। আর মামা সিরামিকস লেবার। ঘটনার পরের দিন মামা রহিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। এরপর পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অসুস্থ অবস্থায় আজকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে এনেছে। অথচ মামা ঠিকমত দাঁড়াতে পারছেনা। চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। উকিল ধরার মত টাকাও নেই যে, জামিন চাইবো। এজন্য সিএমএম আদালতের ২য় তলায় বারান্দায় শুইয়ে রেখেছে পুলিশ। আমরা সঠিক বিচার চাই।’

এ বিষয়ের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার এসআই বলেন, আসামি অসুস্থ রয়েছে। তার চিকিৎসা দরকার। কিন্তু হাসপাতাল থেকে তাকে আজ রিলিজ করে দিয়েছে। এজন্য নিয়ম অনুসারে আজকে আদালত হাজির করতে হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসামি অপরাধী কি নিরপরাধ সেটা তদন্ত শেষ করার পর জানতে পারবো।’

মামলার বাদী মুয়াজ জানান, ‘পল্লবীতে আমার বাসা থেকে তিনটা মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। সেই অভিযোগে রহিমের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। চুরি করার পর সে তিন তলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যায়। তাকে কেউ মারধর করেনি।’

তিনি বলেন, এখন আমরা আসামি রহিম কিভাবে জামিন পাবে, সেটার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে বাদী বলেন, আসলে রহিম মোবাইল চুরি করেছে কিনা সেটা সঠিক বলতে পারছিনা। তবে মোবাইল চুরি হয়েছে, এটা সত্য।

কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি বিরক্ত প্রকাশ করেন।

মামলায় অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ১ অক্টোবর ভোরে বাদী মো. মুয়াজ ঘুমিয়ে ছিলেন। লোকজনের চিৎকারে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পরে তিনটি মোবাইল চুরি হওয়ার কথা জানতে পারেন তিনি। রহিম মোবাইল চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় লোকজনের ডাক ও চিৎকারে তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে আহত হয়। আহত অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে প্রথমে ইসলামী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। চিকিৎসাধীন থাকায় পুলিশ তাকে আদালতে হাজির না করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে আদালত তাকে চিকিৎসা শেষে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে। কিন্তু রহিম পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা আক্তার তাকে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালে চিকিৎসার নির্দেশ দেন।


ঢাকা/মামুন খান/সাজেদ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ