ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

স্মৃতিতে সাহিত্যপত্রিকা ‘নাগরিক’|| আহমদ রফিক

আহমদ রফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৭, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্মৃতিতে সাহিত্যপত্রিকা ‘নাগরিক’|| আহমদ রফিক

আমার সাহিত্যপত্রিকা (ত্রৈমাসিক) ‘নাগরিক’-এর (১৯৬৩-৭০) স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে প্রথম ঢাকায় আসা ও দেখার অভিজ্ঞতা অতি সংক্ষিপ্তভাবে বলা প্রয়োজন। তাতে বোঝা যাবে তখনকার ঢাকার চেহারা-চরিত্র। চল্লিশের দশকের একেবারে শেষ দিক থেকে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ঢাকা উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্ত প্রধান শহর। ঢাকা রেলস্টেশন (ফুলবাড়িয়া) এবং এর দক্ষিণের রেললাইন শহরটিকে চরিত্র বিচারে দু’ভাগে বিভাজিত করেছে। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তীরের ‘পুরনো ঢাকা’ তার ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে সফল ও সচ্ছল। সেইসঙ্গে বাসিন্দাদের সততা ও সারল্য।

নবাবপুর, ইংলিশ রোড, নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর হয়ে পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, বাবুবাজার, বেগমগঞ্জ, চকবাজার ইত্যাদি রাস্তা ও মহল্লা নবাবী আমলের ঘ্রাণ ও জীর্ণস্মৃতি নিয়ে সজীব। পুরনো ঢকার আদি বাসিন্দারা উর্দু বাংলার দোআঁশলা ভাষায় কথা বলে। খাজাদের নবাববাড়ি তথা আহসান মঞ্জিলের বাসিন্দাদের খাস উর্দু বয়ান। বিভাগপূর্ব কালে তাদের নেতৃত্বে মহল্লা সর্দারদের শাসনে ওই আদি বাসিন্দাদের ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষাখাতে অন্ধকারে রাখা হয়। ফলে ওই আদি বাসিন্দা সমাজে ওদের জীবিকা প্রধানত দোকানদারি ও ছোটবড় ঠিকেদারি। ব্যতিক্রম সামান্য।

বিভাগপূর্ব কালে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী, পেশাজীবী শ্রেণী সমাজের প্রধান চালিকাশক্তি। দেশভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা (১৯৪৭-এর আগস্ট) শ্রেণীভাগ ও সম্প্রদায়গত পরিবর্তন ঘটায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপক বাস্তু ত্যাগে, দেশ ত্যাগে,  মূলত সম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতায়। সামান্যসংখ্যক মুসলমান মধ্যবিত্তের দ্রুত উত্থান ও বিকাশ ঘটে পরিত্যক্ত শূন্যস্থান পূরণ করতে। বদলে যেতে থাকে খাজা-কুট্টি-শাঁখা তিনে মিলে ঢাকার সামাজিক-রাজনৈতিক চরিত্র।

ঢাকা শহর পূর্ব ঐতিহ্যমাফিক এরপর থেকেও মহল্লা-প্রধান। তখনো বাইশ পঞ্চায়েতি প্রথার শেষ অধ্যায় চলছে। হিন্দু মধ্যবিত্তের স্থানে মুসলমান মধ্যবিত্তের অবস্থান পেশাজীবীর বিকাশে উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ীদের নিয়ে নতুন পরনো দুই ঢাকার অবস্থান। তবে মূল মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীসমৃদ্ধ আমলা, প্রশাসন, শিক্ষক-অধ্যাপক, সাংবাদিক ও শাসকশ্রেণী তথা মন্ত্রীমণ্ডলী নিয়ে রেললাইনের উত্তরে নতুন ঢকার অবস্থান। রমনা এর প্রাণকেন্দ্র; মন্ত্রীপাড়া, সচিবালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং নতুন ও পুরনো পাড়া তথা মহল্লাগুলো নিয়ে। তখনো নতুন ঢাকা গাছগাছালি প্রধানÑ কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল, পলাশ ও পুকুরগুলো নিয়ে। এখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছাত্রশিক্ষক এলাকা, হল হস্টেলসহ ভাষিক চেতনার রাজনীতি তথা ছাত্ররাজনীতি।

দুই.
পঞ্চাশের দশকের ঢাকা দ্রুত নিজেকে পাল্টাচ্ছে একুশের প্রভাবে শিল্পবাণিজ্যিক এলাকা গঠনে ও সম্প্রসারণে, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভুবন তৈরিতে। প্রদেশটির নাম তখনো পূর্ববঙ্গ, এরপর পূর্বপাকিস্তান। রাজনীতিকেন্দ্রিক একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, একটি করে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (‘প্রকৌশলি’ শব্দটি তখনো চালু হয়নি)।

দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা হাতে গোনা, তেমনি গুটিকয় সাপ্তাহিক। ইংরেজি পত্রিকাও দুটো ‘মর্নিং নিউজ’ ও ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’। অন্যতম প্রধান বাংলা পত্রিকা দৈনিক ‘আজাদ’ ও দৈনিক ‘সংবাদ’। সাহিত্যপত্রিকার সংখ্যা আরো হাতে গোনা। এগুলোর বংশবৃদ্ধি ঘটেছে কিছুটা ষাটের দশকে। পঞ্চাশে এগুলোর প্রচার সীমাবদ্ধ বৃত্তে। তবে একুশের সংকলন ছাপিয়ে রাশি রাশি স্মরণিকা লেখকদের সংখ্যাও খুব দীর্ঘ নয়। সেখানে কবিদের প্রাধান্য। সামান্যসংখ্যক কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। এ অবস্থায় জ্বালানি যোগ করে একুশের ভাষা আন্দোলন একুশের কবিতা ও একুশের স্মরণিকা প্রকাশের ব্যাপকতায়। যদিও প্রকাশকের সংখ্যা সীমাবদ্ধ এবং তাদের অবস্থান পুরনো ঢাকায়। আধুনিক বার্ডস অ্যান্ড বুকস্-এর ঠিকানায় ওয়ারিতে। হালকা চালের ‘অগত্যা’ সাহিত্যপত্রিকাও পুরনো ঢাকায়। পুরনো ‘সওগাত’ পুরনো ঢাকায় টিমটিম করে জ্বলছে, সঙ্গে ‘বেগম’।

এমন এক পরিস্থিতিতে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসটি ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় উজ্জ্বল একটি বিন্দু- সাহিত্যে, গানে, মঞ্চনাট্যে ও নৃত্যে। এখান থেকে দুই মেডিকেল ছাত্রের মালিকানায় ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দুটো সাহিত্য মাসিকপত্র- ‘খাপছাড়া’ ও ‘যাত্রিক’। এদের মূল ব্যক্তি যথাক্রমে মঈদুর রহমান এবং আলীম চৌধুরী। ‘খাপছাড়া’র তুলনায় ‘যাত্রিক’ অধিক পরিচিতি পেয়েছিল।

বন্ধু আলীম চৌধুরী (সহযোগী ছাত্রবন্ধু আহমেদ কবির) প্রমুখের ‘যাত্রিক’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে তখন থেকেই একটি স্বপ্ন মনে বাসা বাঁধতে থাকে নিজস্ব একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের জন্য। কিন্তু সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের মতো অর্থ সম্বল আমার ছিল না। স্বপ্নটা আরো ক্ষুদ্র চরিত্র অর্জন করতে থাকে যখন এ সময়পর্বে জহির (শহীদ জহির রায়হান) একটি পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনায় বহু সময় কাটায় আমার সঙ্গে আলোচনায়। এবং শেষপর্যন্ত একাই প্রকাশ করে ‘প্রবাহ’ পত্রিকাটি। সম্পাদক সম্ভবত আহসান হাবীব। মনে তখন আরো দৃঢ়সংকল্প একটি সাহিত্যপত্র আমি প্রকাশ করবোই। বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র।

তিন.
ষাটের দশকের শুরু। আমি তখন কমলাপুর মহল্লায়। আইয়ুব খাঁর সামরিক শাসন চলছে। জেনারেল আজম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, জনপ্রিয় গভর্নর তার পূর্বপাকিস্তান তথা বাঙালিপ্রীতির কারণে। নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চক্করে লাইনচ্যুত হয়ে ১৯৬০ থেকে আমি দেশের স্থানীয় এক নাম্বার ওষুধ কোম্পানিতে ভালো অবস্থানে চাকরিরত। সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্নটা বাস্তবে পরিণত করার সুযোগ তৈরি হয় এ সময়।

বাংলা একাডেমি পত্রিকা, নিম্নমান সরকারি পত্রিকা বাদে সাহিত্যমাসিক হিসেবে ‘সমকাল’ তখন খ্যাতিমান কবি সিকান্দার আবু জাফরের তৎপরতায়। পাকিস্তানপর্বে ‘সওগাত’ কখনোই পূর্বখ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। এসময় পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার মুখপত্র ‘লেখক সংঘ পত্রিকার’ (পরবর্তী পর্যায়ে ‘পরিক্রম’) বোদ্ধা মহলে যথেষ্ট সুনাম। লেখক সংঘ পত্রিকার সম্পাদক অবশ্য এ পর্বে কবি গোলাম মোস্তফা। তাকে লেখা জোগাড়ে সাহায্য করে সাহিত্যকর্মী শাহাবুদ্দিন আহমদ।

সেখানে লেখা সূত্রে শাহাবুদ্দিনের নিত্য যাতায়াত আমাদের কমলাপুরের বাসায়। আমার সাহিত্য প্রকাশের পরিকল্পনা শুনে খুবই উদ্দীপ্ত শাহাবুদ্দিন। সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তার। সিদ্ধান্ত অবিলম্বে একটি সংকলন প্রকাশ করে নিবন্ধনের জন্য চেষ্টা। আমাদের বন্ধুমহলের এক চিত্রশিল্পী ইমদাদ হোসেন তখন আমার মতোই কমলাপুরের বাসিন্দা। তার সঙ্গে থাকে আরেক চিত্রশিল্পী নিতুন (কুন্ডু)। এখানে এসে আড্ডা জমায় শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী। এদের সৌজন্যে বিনা সম্মানীতে প্রচ্ছদ ওই সংকলনের।

পত্রিকার নাম ঠিক করি ‘নাগরিক’। ঢাকার উঠতি নগর সভ্যতার ভালোমন্দ বিষয়ক বিচার-ব্যাখ্যার চিন্তা মাথায় নিয়ে। শাদামাটা পূর্বোক্ত প্রচ্ছদটি পছন্দসই না হলেও ওতেই কাজ চলে- ভিক্ষার চাল কাড়া বা আকাড়া। কিছু অর্থ সংগ্রহের প্রত্যাশায় ওই সংকলনটিতে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করি একক চেষ্টায়। প্রধানত ওষুধ কোম্পানি থেকে, আমার কর্ম অবস্থানের সুযোগে।

যতদূর মনে পড়ে ‘নাগরিক’ সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল বন্ধু ডা. আলী আছগরের। বিজ্ঞাপনের মূল্য আদায়ে তার পরিশ্রমের তুলনা ছিল না। সম্প্রতি প্রয়াত সেই বন্ধুটি। এমনকি প্রয়াত সাহায্যকারী শিল্পী বন্ধুগণ। এবং প্রয়াত জিন্দাবাহার সেকেন্ড লেনের ছাপাখানার আধো অন্ধকারে ঘামতে ঘামতে প্রুফ দেখা বন্ধু শাহাবুদ্দীন।

সংকলনটি ছাপা হয় তৎকালীন বিখ্যাত গ্রেট বেঙ্গল লাইব্রেরির মালিক ওবায়দুল্লাহ সাহেবের পূর্ববঙ্গ প্রেস থেকে। আগেই বলেছি ছাপাখানাটি ছিল ঘিঞ্জি অন্ধকার জিন্দাবাহার সেকেন্ড লেনের তস্য গলির ভেতরে। বিজ্ঞাপন ভুবনের ঐতিহ্য মাফিক বেশ কয়েকজন বিজ্ঞাপনদাতা বিজ্ঞাপন মূল্য পরিশোধ করেননি। তবু যে অর্থের জোগান এই সংকলন থেকে তা সাহিত্যপত্র ‘নাগরিক’ প্রকাশের জন্য সহায়ক ছিল।

বিজ্ঞাপন সংগ্রহের সুবিধার জন্য তিনজন খ্যাতনামা চিকিৎসক প্রফেসর আমিরুদ্দিন, ডা. এম.এন. নন্দী ও ডা. নুরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে জাতীয় অধ্যাপক)-দের নিয়ে সংকলনের সম্পাদক মণ্ডলী গঠিত হয়েছিল। সঙ্গে আমি ও শাহাবুদ্দীন। অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলোও ফ্যালনা ছিল না। সেখানে ছিল দুই বন্ধু সাইয়িদ আতীকুল্লাহ ও আহমদ মীরের গল্প, শেখভের একটি গল্পের অনুবাদ এবং দুটো স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রবন্ধ। লেখক প্রফেসর আমিরুদ্দিন ও ডা. নন্দী।

ইতিমধ্যে ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে ‘নাগরিক’-এর নিবন্ধন বিষয়ক জটিলতা সম্পাদক-প্রকাশক হিসেবে আমার নাম নিয়ে, রাজনৈতিক কারণে। ১৯৬২-তে আমি আরামবাগে কারণ কমলাপুর ভাঙতে শুরু করেছে নতুন রেলস্টেশন নির্মাণের ধাক্কায়। অগত্যা বাসা স্থানান্তর। কপালগুণে সেকালে কিছুসংখ্যক বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী জুটেছিল কমলাপুর থাকতেই। তাদের একজন ব্যাংকার বোরহানউদ্দিন ভূঁইয়া, আরামবাগ নিবাসী। তার ভগ্নিপতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। তিনিই জানালেন যে, রাজনৈতিক কারণে আমার নামে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি সহজে মিলবে না। সেক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলো বোরহানউদ্দিন ভঁ‚ইয়ার নাম। এসব ঝুট ঝামেলায় বছর দুই কেটে গেল। এমনই ছিল পাকিস্তানি প্রশাসন।

এরপর ‘নাগরিক’ প্রথম প্রকাশ ১৯৬৩-তে শীত সংখ্যা (পৌষ-ফাল্গুন) হিসেবে। এর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চরিত্র এক কথায় উদার প্রগতিশীলতার। নেপথ্যে আর্থ-সামাজিক সচেতনতা, কিন্তু আদর্শিক গোঁড়ামিমুক্ত। তবে পাকিস্তানি রাজনীতির ফ্যাসিস্ট চরিত্র উন্মোচন ছিল ‘নাগরিক’-এর প্রচ্ছন্ন লক্ষ। যেহেতু এটি সাহিত্যপত্রিকা (রাজনৈতিক নয়) তাই প্রথম সংখ্যায় ছোট সম্পাদকীয় নিবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে লেখা হয়: ‘মত পথ গোষ্ঠী ও আদর্শ নির্বশেষে পূর্ব পাকিস্তানের সকল সাহিত্যকর্মীর একটি সুস্থ, সুশ্রী ও বলিষ্ঠ নির্মাণে ঐকান্তিক হবার পথই নাগরিকের পরম অভিষ্ট’। এ সংখ্যাটির এবং দ্বিতীয়টিরও প্রচ্ছদ আঁকেন চট্টগ্রামবাসী চিত্রশিল্পী বন্ধু আশীষ চৌধুরী বিনা পরিশ্রমিকে। তার দাবি ইতিমধ্যে (১৯৫৮) প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’-এর একটি কপি। এমন বন্ধু মেলা ভার।

মোটা কার্টিজ কাগজে ঝকঝকে ছাপা ‘নাগরিক’ অনেকেরই প্রিয় কাগজ হয়ে উঠেছিল। এ সত্য স্বীকার করেছেন পরবর্তী সময়ে একাধিক বিশিষ্টজনÑ কবি আহসান হাবীব ও শামসুর রাহমান, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুন এবং আমার একান্ত প্রিয়জন শওকত ভাই (শওকত ওসমান)। নাগরিকের নিয়মিত গল্প লেখক তিনি এবং কবি শামসুর রাহমান, আহসান হাবীব, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আহমেদ হুমায়ুন প্রমুখ।

এছাড়াও লিখেছেন বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, খুলনার দৌলতপুর কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক (তার গল্প লেখার প্রথম পর্যায়ে), হাসান হাফিজুর রহমান, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আবদুল কাদির, আবদুল হক, বশীর আল হেলাল, নেয়ামাল বাসির, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন, আবদুল গণি হাজারি, সিকান্দার আবু জাফর, মনিরুজ্জামান, অপেক্ষাকৃত তরুণ আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ সমকালীন লেখক।

ব্যতিক্রমী লেখক এক বোহেমিয়ান ফ্রিল্যান্স ফরাসি সাংবাদিক জ্যাক দুগবে। একেবারে তাজা তরুণ কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসান। এছাড়া শাহাবুদ্দিন আহমদ, বুলবন ওসমান প্রমুখ। আমার নিজেরও অনেক ক’টি লেখা ছাপা হয়েছে স্বনামে-বেনামে। যেমন প্রথম সংখ্যায় জ্যঁ পল সার্ত্রের ওপর লেখা দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘সাহিত্যে দর্শন’।

‘নাগরিক’-এর একটি লক্ষ ছিল যতটা সম্ভব বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বরাজনীতির উপস্থাপন এবং পূর্বসূরিদের ধারায় একটি সমৃদ্ধ পুস্তক সমালোচনা বিভাগ সচল রাখা। এ প্রসঙ্গে যেমন এসেছে রুশ সাহিত্য তেমনি ফরাসি সাহিত্য। এসেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী সাহিত্যের প্রকাশ। পুস্তক সমালোচনায় বিশেষভাবে অংশ নিয়েছিলেন অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন, আহমেদ হুমায়ুন, নেয়ামাল বাসির ও শাহাবুদ্দিন আহমদ। ‘নাগরিক’ ১৯৭০ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এরপরই তো একাত্তর। প্রথম থেকে এ সাহিত্যপত্র প্রকাশে পর্যায়ক্রমে সহযোগী হিসেবে ছিলেন শাহাবুদ্দিন আহমদ, বুলবন ওসমান ও সৈয়দ আবুল মকসুদ। মকসুদের বেশ কয়েকটি লেখা ‘নাগরিক’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।

বিস্ময়কর যে ষাটের দশকের এমন একটি সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসে কোনো আলোচনা বা উল্লেখ নেই- কী হতে পারে এর কারণ? এ সম্বন্ধে আমার ছোট্ট একটি লেখা ‘ষাটের দশকের সাহিত্যপত্র নাগরিক’  ছাপা হয় ১৯৯১ সালের ঈদুল আজহা সংখ্যা ‘দৈনিক বাংলা’য়। এই ছিল ‘নাগরিক’-এর সাত বছর স্থায়ী সাহিত্যপথ পরিক্রমা।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়