ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হঠাৎ একদিন ভাসানীর সন্তোষে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪১, ১১ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হঠাৎ একদিন ভাসানীর সন্তোষে

ফেরদৌস জামান : অতি পরিচিত একটি নাম ‘ভাসানী’। যদিও এটি তাঁর আসল নাম নয়। লুঙ্গি পরিহিত তালের টুপি মাথায় দেয়া আব্দুল হামিদ খান নামক লোকটি পিতা-মাতা প্রদত্ত নামের চেয়ে উক্ত নামেই সমধিক পরিচিত। অতি সাধারণ এই মানুষটির সাথে পাঠকদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দুঃসাহস করবো না। কারণ সাধারণ হলেও আমাদের ইতিহাসে তিনি অসাধারণ একটি আসন দখল করে আছেন। যে কারণে তাঁর সঙ্গে আমরা শৈশব থেকেই কম-বেশি পরিচিত। সামরিক জান্তার মসনদ কাঁপিয়ে দেয়া নিপীড়িত মানুষের নেতা ভাসানীর স্মৃতিবিজড়িত ভারতের আসাম রাজ্যে যাওয়ার ইচ্ছা সাধ্যে না কুলালেও সন্তোষ যেতে বোধ হয় খুব বেশি কাঠ-খড় পোরাবার দরকার পরবে না এমনটাই ছিল ভাবনা। আমার এই লেখা থেকে সেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে প্রত্যাশা করি।

জুন কি জুলাই মাস, প্রতিনিয়ত বৃষ্টির আশঙ্কা। আগের দিন রাতে কামরুজ্জামান অনিক ফোন করে জানাল, আগামীকাল সে টাঙ্গাইল যাচ্ছে, ভোরে মেট্রো শপিং মলের সামনে থাকা চাই। তখন আমি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কাছাকাছি শুক্রাবাদের বসিন্দা। যাইহোক, প্রতি উত্তরে কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিল। কারণ সে জানে হঠাৎ পরিকল্পনায় বরাবরই আমি কোনো না কোনো ছুতো খোঁজার চেষ্টা করি। কারণ আমার সবসময়ই মনে হয়, কোথাও বেড়াতে বা ভ্রমণে যাব- এজন্য পূর্ব পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি থাকা দরকার। কিন্তু কামরুজ্জামানের ভাবনা ঠিক তার উল্টো। ওর সঙ্গে বহু জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি কিন্তু যতদূর মনে পড়ে একটি বারও পরিকল্পনা করে নয়।

ভোরবেলা ফোনে একটা এসএমএস দিয়ে জানাল মেট্রোর সামনে সে অপেক্ষা করছে। যাওয়া না যাওয়া সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তবে আমি না গেলে সেও নড়ছে না। অগত্যা তৈরি হয়ে গিয়ে দেখি, সে শুধু একা নয়, গড়ির ভেতর আল-আমিন এবং হাফেজ আমিন বসা। উপস্থিত হওয়ামাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল বেদম গতিতে। ভোর বেলার ফাঁকা রাস্তা, সকালের নাস্তার পরিকল্পনা সরাসরি পোড়াবাড়ি গিয়ে। গরম চমচম দিয়ে নাস্তা, কে কয়টা বা কত কেজি খাবে সেই গল্প চললো বেশ খানিকক্ষণ। পোড়াবাড়ি গিয়ে অদ্যবধি একমাত্র বিরতি। দোকানের পেছনে গিয়ে দেখি মণকে মণ চমচম বানিয়ে রাখা হয়েছে। কামরুজ্জামান আগে থেকেই ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে রেখেছে কোন দোকানের চমচম সবচেয়ে ভালো। লোভে মুখের ভেতর জিভ তখনই নাচতে শুরু করল। কখন পরিবেশিত হবে!

 



বৃদ্ধ দোকানদার নিজেই হালাইকর (চমচমের কারিগর)। চেয়ার থেকে উঠে হেলেদুলে পাতিল থেকে চমচম তুলে আনতে আনতে পেরিয়ে গেল মিনিট পাঁচেক। একটা দুইটা নয় বরং বেশ কয়েকটা খাব বলে নিজেও ঠিক করে রেখেছিলাম কিন্তু কি জানি কি হলো মাত্র দুইটা খাওয়ার পর আর পেরে উঠলাম না। ঘটনাটি কেবল আমার ক্ষেত্রে নয় বরং প্রত্যেকের বেলাতেই তাই ঘটল। আশানুরূপ খেতে না পারার মনো বেদনা নিয়ে রওনা করলাম সন্তোষের দিকে। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন মজলুম জননেতা ভাসানী।

সন্তোষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে কামরুজ্জামান হাঁকিয়ে চললো তার টয়োটা প্রবক্স। কালো মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে আসায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা ঠিক ঘুরে দেখা হলো না। কেবল লাল ইটের তোরণ দেখেই সাধ মেটাতে হলো। একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে গেলাম সন্তোষ। বড় বড় আম গাছের ডালপালায় ঢাকা চারপাশ, সাথে খোলা জায়গা। ঠিক তার এক প্রান্তে বেশ বড় একটি কক্ষ। শুরু হয়ে গেল প্রবল বর্ষণ। আশপাশে কোনো মানুষ নেই। গাড়ি থামিয়ে বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর যখন বোঝা গেল বৃষ্টি সহজে থামবার নয় তখন নেমে পড়ি। এরই মধ্যে পানিতে ভরে গেছে মাঠ। দ্রুত গিয়ে প্রবেশ করি কক্ষটির ভেতর। কক্ষের মাঝখানে মলিন কাপড়ে ঢেকে দেয়া একটি সমাধী। চারপাশে ভোতা হাতে নির্মিত রেলিং, নেই কোনো জৌলুস, নেই কোনো মখমল অথবা টাইলস-পাথরের আচ্ছাদন। খুব সাদামাটা স্থাপনা, কবে কোন কালে শেষ সংস্কার করা হয়েছে কে জানে! পরিস্থিতি দেখে মনে হলো ঘরটির মধ্যে মাঝেমধ্যে গরু-ছাগলেরও প্রবেশ ঘটা অস্বাভাবিক নয়।

পাশে বাঁশের চাটাই ও খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি করে রাখা হয়েছে একটি ছোট্ট প্রতীকী ঘর। তার অবস্থাও বেহাল, কখন যে ভেঙ্গে পরবে ঠিক নেই! অথচ অধিকার হারা ও বঞ্চিতদের জন্য সমস্ত জীবন দিয়ে লড়ে গেছেন তিনি। লড়ে গেছেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য। যেখানে থাকবে না ভেদাভেদ, থাকবে না বৈষম্য। আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন সুখ সম্ভোগ তুচ্ছ জ্ঞান করে জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের  নামই প্রকৃত জীবন। রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুদের কথা যদি বাদও দেয়া হয়, পাতি জনপ্রতিনিধি সারা জীবনের সাধনাই যার জচ্চুরি আর লুটপাট, তার কবরেও কম করে হলে দু’একটি শ্বেত পাথরের ফলক থাকে। কিন্তু আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ঘুমিয়ে আছেন সামান্য এক কুঁড়ে ঘরে! বর্তমানের অবস্থা কি জানি না, কারণ আমার এই অভিজ্ঞতা আজ থেকে প্রায় আট বছর আগের।

 



অল্প কয়েক বছর আগেও বাজারে দশ টাকার নোট দেখা যেত, যার এক পাশে ছিল একটি মসজিদের ছবি। ছবিটির নিচে লেখা আতিয়া জামে মসজিদ, টঙ্গাইল। সন্তোষ থেকে এবার আমরা রওনা করলাম সেই মসজিদ দেখার উদ্দেশ্যে। বৃষ্টি থেমে গেছে তবে বাতাসের সাথে আকাশের পাতলা মেঘ ছোটাছুটি করছে। ফাঁকা মাঠের মাঝ দিয়ে পিচ ঢালা উঁচু পথ। লোকে যেমন বলছে তেমনই চলছি। কোন দিক ঘুরে কোন দিকে যাচ্ছি তার ঠিক ঠিকানা নেই। মৃদু বাতাস বইছে আর সেটাই ভালো লাগছে। সরু পথের মাঝে মিলে যায় একটি আজব বাহন, গরুর গাড়ি আকৃতির মাল টানা গাড়ি, আকারে একটু ছোট। ব্যাতিক্রম কেবল এতটুকুই, গরুর জায়গায় একটি ঘোড়া। গাড়িয়ালের দেখিয়ে দেয়া পথে মিনিট বিশেক এগিয়ে যাওয়ার পরও সেই জায়গাটি আর খুঁজে পাইনি। সেখান থেকে ফেরার পথে পুনরায় দেখা হয়ে গেল তার সাথে। তাকে দেখে রাগ বেড়ে গেল। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকাতেই একটি নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বলল, আমি যে ভুল পথ দেখিয়ে দিয়েছি টের পাইনি। যখন বুঝলাম তখন পেছন থেকে চিৎকার করে অনেক ডেকেছি কিন্তু আপনারা শুনতে পাননি। সুতরাং আমাদের রাগ গেল পানি হয়ে! হাফেজ আমিন বলল, ভুল করেছেন ভালো কথা এবার তার মাশুল গুনতে হবে! মাশুলস্বরূপ তার গাড়িতে চড়ে বেশ খানিকটা পথ যেতে চাইলে সে খুব খুশি হলো।

টাকার গায়ে আতিয়া জামে মসজিদ লেখা থাকলেও স্থানীয়রা বলেন আটিয়া মসজিদ। রাস্তা থেকেই মসজিদ দেখা যায়। কয়েক মিনিট হেঁটে গেলে মসজিদ চত্বর। সবুজ ঘাসের জমিনের উপর লাল ইটের প্রাচীন মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে। আবহাওয়া খারাপ তাই কোনো দর্শনার্থী নেই। স্থানীয় একজন মানুষও পেলাম না যার নিকট অন্তত মসজিদের বর্তমান বৃত্তান্ত জানতে চাইব। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের মধ্যে এটি একটি মূল্যবান স্থাপনা। ভেবেছিলাম আতিয়া নামের কোনো নারীর নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ হয়েছে। আসলে অত্র এলাকার নাম আতিয়া আর সে অনুসারেই নামকরণ। পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৬০ বাই ৩০ ফুট দীর্ঘ। মসজিদের দেয়াল প্রায় ছয় থেকে সাত ফুট প্রশস্ত। স্থানীয়ভাবে এটি নিয়ে রয়েছে নানা লোককথা যার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। বারান্দার পর মূল কক্ষের প্রধান প্রবেশ পথের উপরের অংশে একটি শিলালিপি আছে। লিপির পাঠোদ্ধার করে জানা গেছে মসজিদটি ১৬০৮ সালে নির্মিত। মোঘল আমলে আতিয়া ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। সুতরাং মসজিদের চারদিকে প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার এলাকার মধ্যে আরও প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে বলে জানা যায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম যদি কাউকে পাওয়া যায় কিন্তু পেলাম না। পুনরায় ঝুম বৃষ্টি চলে আসায় সে আশা না করে ঢাকার দিকে রওনা দিলাম।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়