ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হবিগঞ্জের হাওরজুড়ে কৃষকের কান্না

মামুন চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ২৪ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হবিগঞ্জের হাওরজুড়ে কৃষকের কান্না

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : হবিগঞ্জে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বড় বড় হাওরের ফসল নষ্ট হয়েছে।

কৃষি বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের ৪৫ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

তবে স্থানীয় সূত্র দাবি করছে, প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। কৃষকরা তলিয়ে যাওয়া জমিগুলোর কিছু পাকা ও আধা পাকা ধান কেটে এনেছিলেন। কিন্তু টানা বৃষ্টির জন্য সেগুলো খলার মধ্যে আঁটি বাধা অবস্থায় পঁচন ধরেছে। রোদ না থাকায় সেগুলো শুকানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কৃষকরা এখন হাহাকার করছেন। দিশেহারা হয়ে পড়ছেন অনেকে।

নিজদের খাদ্য সংকট ও হালের বলদের খাদ্য সংকটে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকে মহাজনের ঋণ পরিশোধ কিভাবে করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

হবিগঞ্জ কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে জেলার ৮টি উপজেলায় প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু চৈত্রের শেষ দিকে অকাল বন্যা, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার গুঙ্গিঁয়াজুরি হাওর, গণকির হাওর, ভরগাঁও হাওর, কালুয়ার বিল, আতুকুড়া হাফরার বিল, খাগাউড়া হাওরসহ অধিকাংশ এলাকার জমির ফসল তলিয়ে গেছে।

আতুকুড়া গ্রামের কৃষক আজম আলী জানান, হাফরার হাওরে তার ১১২০ শতক জমি রয়েছে। সব জমি তলিয়ে গেছে। কিছু জমির আধা পাকা অবস্থার ধান কেটে এনে খলায় রেখেছেন। রোদ না ওঠায় সেগুলো এখন খলার মধ্যে পঁচে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, নিজের খাবার ও গো-খাদ্যের জন্যে অনেকটা বিপাকে পড়তে হবে তাকে।

খাগাপাশা ইউনিয়নের বাগহাতা গ্রামের কামাল মিয়া জানান, এলাকার কৃষকদের প্রায় সকল জমিই তলিয়ে গেছে। তলিয়ে যাওয়া অনেক জমির আধা পাকা ধানগুলো কেটে খলার মধ্যে রাখা অবস্থায়  পঁচে যাচ্ছে।



সুবিদপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, আমার ইউনিয়নের বলাকীপুর, আকুতুড়া, সুনারু, নতুন নোয়াগাঁও ও নোয়াগাঁও হাওরসহ আরো বেশ কয়েকটি হাওরের প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। এখন উঁচু স্থানের জমিগুলোও তলিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সব কৃষকদের তালিকা করেছি। কৃষকদের এই দুর্দিনে সমাজের বিত্তশালীদের তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

মক্রমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহাদ মিয়া জানান, এ ইউনিয়নের হাওরগুলোর নিচু এলাকার সব জমি তলিয়ে গেছে। এখন উঁচু স্থানের জমিগুলোও তলিয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা সেই জমিগুলোর আধা পাকা ধান নিজেরাই কাটছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে অবশিষ্ট জমিগুলোর আধা পাকা ধান কাটতে পারছেন না।

কুমড়ী গ্রামের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট আয়ুব আল আনছারী জানান, এবার তার ১৬৮০ শতক জমি চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে সব জমিই পানিতে তলিয়ে গেছে। ১/২টি জমির আধা পাকা ধান কাটলেও বৃষ্টির কারণে ধানগুলো খলার মধ্যে পঁচে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, শুধু আমাদের নয়, গ্রামের প্রাক্তন মেম্বার মিজান মিয়ার  ৩০৮০ শতক, বর্তমান মেম্বার মমতাজ মিয়ার ১৬৪ শতক, ফারুক আমীন তালুকদার পরিবারের ১৫৬ শতক, নুরুল ইসলামের ৫৬০০ শতকসহ সকল কৃষকদের জমি তলিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় কৃষকরা যেমন খাদ্য সংকটে পড়বেন, তেমনি তাদের গরু-বাছুরেরও খাদ্য সংকট দেখা দিবে। এতে অনেকেই এখনই গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

পৈলারকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জয়নাল আবেদীন তালুকদার বলেন, আমাদের ইউনিয়নের প্রায় ১৬ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকরা যেমন খাদ্য সংকটে পড়বেন তেমনি গো-খাদ্যের অভাবে অনেকেই তাদের হালের বলদ বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, কৃষকদের দুর্যোগ মুহূর্তে সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

আজমিরীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা টিটন খীসা জানান, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আজমিরীগঞ্জের সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে ফসল নষ্ট হয়েছে। এখন যেসব জমি পানির কিছু ওপরে রয়েছে, সেগুলোর আধা পাকা ধান কাটার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহযোগিতার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষে থেকে ১৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করবো।

বানিয়াচং উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশী। এই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল আজাদ জানান, এই উপজেলার ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, অকাল বন্যা, অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই, নবীগঞ্জসহ ৭টি উপজেলার প্রায় ৪৫ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

তিনি জানান, কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টি তারা মনিটরিং করছেন। সরকারিভাবে যেটুকু সহায়তা করা সম্ভব সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৈকত হোসেন জানান, বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। হাওরে পানি বাড়ছে। হবিগঞ্জ শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খোয়াই ও আজমিরীগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম জানান, বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও লাখাই উপজেলার কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য জিআরও’র মাধ্যমে ২০৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো প্রত্যেক উপজেলার নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত সকল উপজেলায়ও সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।



রাইজিংবিডি/হবিগঞ্জ/২৪ এপ্রিল ২০১৭/মো. মামুন চৌধুরী/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়