ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হাফিজ হত্যা : ঘাতকরা খাবারও খেতে দেয়নি

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৯ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাফিজ হত্যা : ঘাতকরা খাবারও খেতে দেয়নি

খেয়া পারাপারে রাজি না হওয়ার অপরাধে খুন হওয়া যুবক হাফিজুর রহমান ওরফে হাফিজ হত্যা মামলার বিচার ১৭ বছরেও শেষ হয়নি।

১৭ বছর আগে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জে খুন হন হাফিজ। হাফিজকে খাবারের টেবিল থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। স্বজনরা লাশ খুঁজে পেলেও ১৭ বছরে হাফিজুর হত্যার বিচার পাননি। স্বজনেরা বিচারের আশায় আছেন। কিন্তু সেই বিচার কবে শেষ হবে?

দীর্ঘ এত বছরে মাত্র একজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কবে নাগাদ মামলাটির বিচার শেষ হবে বলতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষী হাজির না করাই পুলিশকে দুষছে রাষ্ট্রপক্ষ। আর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার মূল কারণ মামলার পাঁচ আসামিই পলাতক।

মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শরীফ এ এম রেজা জাকেরের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ১৯ নভেম্বর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিনও কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এজন্য আদালত আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিধ ধার্য করেন।

মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আব্দুল মান্নান জানান, দীর্ঘদিন সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। সাক্ষী নিয়মিত আসলে মামলা শেষ হতে এত সময় লাগার কথা না। সাধারণত মামলার কার্যক্রম হাইকোর্ট স্থগিত করলে, সাক্ষী না আসলে অথবা পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারলে মামলা বিচার বিলম্ব হয়। আদালত থেকে সাক্ষীদের প্রতি সমন ইস্যু করা হয়। পুলিশের দায়িত্ব সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা। এরপর সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণে সাহায্য করবেন। মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয় সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর রেহানা আক্তার জানান, দায়িত্ব পাওয়ার পর পুরনো মামলা যেন দ্রুত শেষ হয় সেদিকে খেয়াল রেখে কাজ করে যাচ্ছি। মামলাটি অনেক পুরনো। আদালত থেকে সাক্ষীদের সমন পাঠানো হয়। কিন্তু থানা পুলিশের অবহেলার কারণে অনেক সময় তা জারি হয় না। মামলাটি আদালত সাক্ষীদের প্রতি অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। শুধু পুলিশের আশায় না থেকে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীদের আদালতে হাজিরের ব্যবস্থা করবো। আগামী তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী আদালতে হাজির করার কথা জানান তিনি।  

হাফিজ নিহতের ঘটনায় তার মা আলেয়া খাতুন ২০০৩ সালের ১৮ অক্টোবর কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, মেজো ছেলে হাফিজুর রহমান ওরফে হাফিজ এবং ছোট ছেলে রবিউলকে কালিগঞ্জ এলাকায় রেখে গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর চলে যান। হাফিজ তেলঘাটে খেয়া পারাপার করতো। ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর হাফিজ কাজ শেষে কালিগঞ্জ বৌবাজার যায়। সেখানে তার শ্যালিকা পারুলের সাথে দেখা হলে সে তাকে তার খালা শাশুড়ি ফুলবানুর বাসায় নিয়ে যায়। তাদের পিছন পিছন আসামি মামুন, সোহেল, ছোট শরীফসহ অজ্ঞাতনামা ৭/৮ জন ওই বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে হাফিজকে বলে ১২টার সময় নদী পার করে দিতে। হাফিজ অস্বীকৃতি জানায়। পারুল হাফিজকে ভিতরে নিয়ে ভাত খেতে দেয়। ভাত খাওয়া অবস্থায় মামুন, সোহেল, ছোট শরীফ ঘরে ঢুকে জোরপূর্বক টানা হেঁচড়া করে হাফিজকে নিয়ে যায়। পরে আত্মীয়-স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হাফিজকে পায়নি। পরে জানতে পারি আসামিরা তাকে এমভি সৈয়দপুর লঞ্চে নিয়ে মারপিট করে খুন করে বস্তায় ভরে লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়।

পরের বছর ১২ এপ্রিল মামলাটি তদন্ত করে ডিবি পুলিশের এসআই আব্দুর রাজ্জাক। পুলিশ ছোট শরীফ, উজ্জল, মামুন, সোহেল ও মৃদুলকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ভিকটিম ও আসামিদের স্বভাব-চরিত্র ভাল না। তারা নদী-পথে ডাকাতি-ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত ছিল। লুন্ঠন করা মালামাল ভাগ-বাটোয়ারা এবং অন্তঃদ্বন্দ্বের কারণে আসামিরা ৩ অক্টোবর হাফিজকে তার খালা শাশুড়ির বাসা থেকে তুলে নিয়ে চর কালিগঞ্জ তরিক মিয়ার ডগ ইয়ার্ড এর নিকট বুড়িগঙ্গা নদীতে এম ভি সৈয়দপুর দোতলা লঞ্চে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে মারপিট করে গলা কেটে হাত-পা বেঁধে চটের বস্তায় ভরে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নদীতে ফেলে দেয়।

২০০৬ সালের ২৫ মে মামলায় পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এরপর দীর্ঘ ১৩ বছরে কোন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। গত বছরের ১ জুলাই আদালত চার্জশিটভুক্ত ১৩ সাক্ষীর বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

এরপর গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর এম ভি সৈয়দপুর লঞ্চের কর্মচারী মনির হোসেন নামে এক সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। এরপর আদালত মামলার বাদী পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি বালিহারি গ্রামের মো. আব্দুল কাদেরের স্ত্রীকে পুলিশ সুপারের মাধ্যমে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যুর আদেশ দেন। এরপর গত ১৯ নভেম্বর মামলাটির তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিনই তিনি আদালতে হাজি হননি।

এদিকে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় ছোট শরীফ, মামুন ও উজ্জল জামিন নিয়ে পালিয়ে যায়। বর্তমানে মামলার পাঁচ আসামিই পলাতক রয়েছেন।

গত ১৯ নভেম্বর আদালত পলাতক আসামিদের পক্ষে অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিনকে স্ট্রেট ডিফেন্স হিসেবে নিয়োগ দেন। মামলা সম্পর্কে তার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।


ঢাকা/মামুন খান/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়