ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হালখাতার সেকাল-একাল

অঞ্জন আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৯, ১২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হালখাতার সেকাল-একাল

অঞ্জন আচার্য : একটা সময় সৌরপঞ্জিকা অনুসারে পালিত হতো বাংলার বারোটি মাস। এই পঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগোরীয় পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। তখন নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ পালিত হতো আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। এরপরে মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে শুরু হয় পয়লা বৈশাখ উদযাপন। আর এর সাথে শুরু হয় বাংলা সনের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীদের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। সে সময় প্রজারা খাজনা পরিশোধ করতেন চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত। পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি করতেন আনন্দ উৎসব। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও দোকানদার বৈশাখের শুরুর দিনে করতেন ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান। নিজ নিজ ধর্মের রীতি অনুযায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে শুরু করে বছরের প্রথম দিনটি।

দুটি আরবি শব্দ ‘হাল’, মানে চলতি এবং ‘খাতা’, যার অর্থ হিসাবের বহি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন আমলেই এই শব্দদ্বয় মিশে যায় বাঙালির ধারাবাহিক জীবনপ্রবাহে। অতীতে হালখাতা ছিল বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। বৈশাখের প্রথম দিন গ্রামবাংলা, মফস্বল বা শহরে, ছোট-মাঝারি-বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হতো হালখাতার। পুরোনো হিসাবের খাতা বন্ধ ও নতুন খাতা খোলার আনন্দ-আয়োজন; আপ্যায়ন ও আনুষ্ঠানিকতার নামই হালখাতা। এ উপলক্ষে ছাপানো হতো নিমন্ত্রণপত্র, চলত নানা আয়োজন। উৎসব-উদ্দীপনার মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো হালখাতা উৎসব। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরোনো খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে স্থাপন করতেন ব্যবসায়িক যোগসূত্র।

গ্রামের হালখাতা আর শহরের হালখাতার মধ্যে ছিল ভিন্নতা। গ্রামের হালখাতাতে ব্যবসায়ীরা বৈশাখের প্রথম দিনে সকালে এসে দোকান পরিষ্কার করে কাগজের ফুল দিয়ে সাজাতেন বর্ণিল সাজে। দোকানের সামনে কারিগরকে দিয়ে তৈরি করা হতো মিষ্টান্ন, গরম জিলাপি। যা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো খদ্দেরকে। কেউবা খদ্দেরকে আপ্যায়ন করাতেন দই-চিড়া-মিষ্টি বা বুন্দিয়া দিয়ে। শহরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে নানা রঙের আলোকসজ্জায় সাজাতেন দোকান। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি পালিত হয় আজও। এটি বাংলা নববর্ষ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করা একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা লাল খাতায়, যা টালিখাতা বা খেরোখাতা নামেও পরিচিত সেই খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে হালখাতার উদ্ভব। এ জন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের আমন্ত্রণপত্র পাঠান। আগে হালখাতা উৎসব অন্য রকম একটা আনন্দ ছিল। যার যার সাধ্যমতো কার্ড ছাপানো হতো আর কার্ডে লেখা থাকত। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা লিখতেন ‘এলাহী ভরসা’ আর হিন্দুরা তাদের কার্ডের ওপর লিখতেন ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ’। হিন্দুদের হালখাতার আমন্ত্রণপত্রটি ছিল অনেকটা এমন- গোলাপি রঙের কার্ড, চারদিকে খাঁজ কাটা, গণেশের ছবির ওপর লেখাটা সুপারইমপোজ করা।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হালখাতার অনেক হাল-ফ্যাশনের কার্ড হয়েছে আজকাল। খদ্দেররা সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আসেন তাদের বার্ষিক বকেয়া শোধ করতে। সামর্থ্য অনুযায়ী শোধ দেন। মিষ্টিমুখ করেন। এতে আরো মধুর করে তোলে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের রসায়ন। ঐতিহ্যের এই আয়োজন ধরে রাখতে ক্রেতার আগ্রহে প্রতিবছর সাড়া দিতে উন্মুখ থাকেন বিক্রেতারাও। পুরোনো হিসাব নতুন করে হালনাগাদ করার আয়োজন হালখাতা, যেখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকে সর্বোচ্চ ভালো আয়োজনের।

হালখাতার এই আয়োজন কেবল বাংলাদেশেই নয়; ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট-বড়, মাঝারি যেকোনো দোকানেই এ উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়। পয়লা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন এই কামনায় যে, সারা বছর যেন তাদের ব্যবসা ভালো যায়। তারা গণেশ পূজা দিয়ে আগরবাতির ধোঁয়া, সোনা-রুপার জল ও সুগন্ধি জল ছিটিয়ে হালখাতার মাধ্যমে লেনদেন শুরু করেন। দেবতার পূজা অর্চনার পর তার পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুর ও চন্দন চর্চিত খাতায় আরম্ভ হয় নতুন বছরের হিসাব-নিকাশ। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেও হালখাতা বা শুভ মহরত অনুষ্ঠান করে থাকেন অনেক ব্যবসায়ী। এই দিনে মুসলিম ব্যবসায়ীরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মিলাদ মাহফিল ও গোলাপজল ছিটিয়ে শুরু করেন বছরের প্রথম দিনের কাজ।

হালখাতা ঘিরে ব্যবসায়ীরা নতুনভাবে সাজিয়ে তোলেন তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ধুয়েমুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন, অনেকে আবার নানা রঙের বাতি, ফুল, দিয়ে সাজিয়ে তোলেন দোকানঘর। ব্যবসায়ীরা হালখাতার নিমন্ত্রণপত্র ক্রেতা বা ব্যবসায়ীর বাড়িতে পাঠান। ‘শুভ নববর্ষ’ বা ‘শুভ হালখাতা’ লেখা ব্যানারও ঝুলিয়ে দেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে। ক্রেতাদের আনন্দদানের জন্য মিষ্টান্ন, লুচি, মৌসুমী ফল ও ঠান্ডা পানীয় প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন। বিক্রেতারা যখন মেজবানের ভূমিকায় তখন ক্রেতারা আসেন অতিথি বেশে। দেনা শোধ করার চেষ্টার বিপরীতে মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন উপহারও। তবে আধুনিক সময়ের পাওনা পরিশোধে নতুনত্ব থাকলেও হাজার বছরের ঐতিহ্য হালখাতার চল ধরে রাখার চেষ্টা চলে পুরান ঢাকায়। সেখানকার চকবাজারের মনোহারির দোকান, তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজারের স্বর্ণের দোকান, বাংলাবাজারের বইয়ের দোকান, শ্যামবাজারের আড়তখানা, ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন বিশেষভাবে চোখে পড়ে আজও। তবে বাস্তবতা হলো, আগের মতো সেই জৌলুস নেই এই হালখাতা উৎসবে। অনেকেই হালখাতা করে আসছেন কেবলই নিয়ম রক্ষার জন্য। কারণ বর্তমানে চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা প্রায় সবাই গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জির ওপর ভিত্তি করে আয়-ব্যয় করেন। নগদ বিক্রি অথবা বাকি লেনদেন সবই হয় ওই মাসের ওপর ভিত্তি করে। তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হালখাতার প্রথা। অন্যদিকে সবাই যখন একই দিনে হালখাতার তারিখ নির্ধারণ করেন তখন সব বকেয়া আদায় হয় না বলেই মনে করেন ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে তারা দেখান, একই খদ্দেরের একাধিক দোকানে বাকি থাকতে পারে। তাই পয়লা বৈশাখে অনেকেই এখন আর হালখাতা করে না।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানে হালখাতার রীতি বা আমেজ এখন আর তেমন নেই। হিসাব রাখার জন্য ব্যবহৃত লাল মোড়কের বিশেষ খাতার পরিবর্তে এখন হিসাব সংরক্ষণ করেন কম্পিউটারে। ফলে কালের বিবর্তনে, কালের গর্ভে হারাচ্ছে বাঙালির প্রাণের এই উৎসব। আধুনিক যুগের অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবীর কাছে টিকতে পারছে না এই সনাতন রীতি। ফলে হালখাতার দিনে পুরোনো খাতা বাদ দিয়ে নতুন খাতার যে আবেদন, তা অনেকাংশে কমে গেছে। ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে আগে যে হৃদ্যতা ছিল, এখনকার সময়ে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এ যেন যাযাবরের উপন্যাস ‘দৃষ্টিপাত’-এর সেই অমর বাক্যটি- ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ!’ তবুও হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও কোনো কোনো ব্যবসায়ী হালখাতার ঐতিহ্যটুকু ধরে রেখেছেন নিজেদের সাধ্য সামর্থ্যরে মধ্যেও। এখনো মিষ্টিমুখে শুরু হয় বছরের শুরুর দিনটি।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়