ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

স্মরণ

হুমায়ুন আজাদকে মনে পড়ে || টোকন ঠাকুর

টোকন ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১১ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হুমায়ুন আজাদকে মনে পড়ে || টোকন ঠাকুর

মানুষ জন্মায়, বড় হয়ে জীবনযাপন করে, বংশ বিস্তারে ভূমিকা রাখে, একদিন বৃদ্ধ হয়ে মরেও যায়। কোনো কোনো মানুষ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে আপন মহিমায়, সতত উজ্জ্বলতায়। হয়ত কোনো মানুষ মৃত্যুর পর কোনো সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকারে একদল জোনাকির ভিড়ে আরেকটি জোনাকি হয়ে যায়। হয়ত কোনো মানুষের সত্তা মৃত্যুর পর আরও এক সন্ধ্যার অন্ধকারে গন্ধরাজ হয়ে ফোটে। হয়ত কোনো মানুষ এমন এক সুবাসে প্রকাশিত হয়, সেই সময়, সেই রাতে পাড়াগাঁর কারো হয়ত ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না। লাল নীল দীপাবলিতে উচ্ছ্বসিত হয় সমস্ত শহর। এই সময় আমার মনে পড়ে হুমায়ুন আজাদকে। কবি, ভাষা বিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক, শিশুদের জন্য উৎকৃষ্ট রচনার লেখক হুমায়ুন আজাদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের খুবই প্রভাবশালী প্রজ্ঞার অধিকারী অধ্যাপক ছিলেন, পড়াতেন বাংলা বিভাগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবস্থান কলা ভবনে, কিন্তু আমি পড়ালেখা করেছি চারুকলায়। ফলে, হুমায়ুন আজাদের সরাসরি ছাত্র হতে পারিনি। ছাত্র শিক্ষকের মতো সম্পর্কও দাঁড়ায়নি আমাদের। তবে ১৯৯০ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত স্যারের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এর প্রধান কারণ অবশ্যই বাংলা কবিতা। কবিতা লিখছি বলেই বনভূমির মধ্যে যেমন গগণ শিরিষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে আমার, কবিতার জন্যেই হাজার হাজার অধ্যাপকের ভিড়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সম্পর্কের বয়স ছিল প্রায় পনেরো বছর।

ফুলার রোড ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে সপরিবারে থাকতেন ডক্টর আজাদ। স্যারের বাসায় যাওয়া পড়েছে আমার, যখন মৌলি-স্মিতারা বড় হয়ে উঠছিল। মৌলি ও স্মিতা স্যারের কন্যাদ্বয়। আমিও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্র থাকা অবস্থায় আমি নবপ্রকাশিত দৈনিক ‘মুক্তকণ্ঠ’র সাহিত্য সাময়িকী আট পৃষ্ঠার ‘খোলা জানালা’য় চাকরি করতাম। খোলা জানালাতেই হুমায়ুন আজাদ স্যারের উপন্যাস ‘রাজনীতিবিদগণ’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রতি সপ্তাহে এক কিস্তি করে ছাপা হচ্ছিল। আমার অফিসিয়াল ডিউটি ছিল উপন্যাসটির অগ্রিম দু’ তিন কিস্তি স্যারের বাসা থেকে মুক্তকণ্ঠ অফিসে নিয়ে আসা। মাঝেমধ্যে স্যারের বাসায় গিয়ে সম্মানীর চেক দিয়ে আসতে হতো। স্যার হয়ত বাসায় নেই কিন্তু আমি লেখা আনতে গেছি, দু’ কিস্তি লেখার সঙ্গে আমাকে তাঁর লেখা সম্পর্কিত চিরকুট রেখে যেতেন। ঠিক এর এক-দু’ বছর পরেই ঢাকায় মোবাইল ফোনের গণহারে প্রবেশ ঘটেছে। স্যার কখনো হাতে লেখা কিস্তি দিতেন, কখনো কম্পিউটারে কম্পোজ করে প্রিন্ট কপিও দিতেন। হুমায়ুন আজাদ লেখা কম্পোজ করতেন বাসায় নিজের কম্পিউটারে, প্রিন্ট করাতেন নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে কিংবা শাহাবাগের আজিজ মার্কেটে। স্যার বাসায় না থাকলে আমার জন্য যে চিরকুট লিখে রাখতেন, তাতে হয়ত লেখা থাকত নীলক্ষেতে বা আজিজ মার্কেটের কোন দোকানে গেলে প্রিন্ট কপির কিস্তি পাব। কিস্তি বলতে ‘রাজনীতিবিদগণ’ উপন্যাসের কিস্তি। উপন্যাসটি এখন বাজারে পাওয়া যায়। কোথাও চোখে পড়লেই আমার মনে পড়ে আমি এই উপন্যাসের বেশিরভাগ কিস্তি ফুলার রোডে হুমায়ুন আজাদের বাসা থেকে কারওয়ানবাজারে দৈনিক মুক্তকণ্ঠ অফিসের খোলা জানালা বিভাগে নিয়ে যেতাম। হঠাৎ হঠাৎ আমার মনে পড়ে হুমায়ুন আজাদকে।

চারুকলার সামনের পাঁচিলের উপর পা ঝুলিয়ে আমরা বসে থাকতাম। টিএসসি থেকে শাহাবাগগামী মানুষের আসা-যাওয়া দেখতাম। দেখতাম হুমায়ুন আজাদ স্যার প্রায় প্রত্যেকদিন বিকালে চারুকলার সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে শাহাবাগ যেতেন, আজিজ মার্কেটে যেতেন। হেঁটে হেঁটেই ফুলার রোডে ফিরতেন। আজিজ মার্কেটে নতুন বইপাড়ায় পাঠক সমাবেশ কিংবা প্যাপিরাস-এর মোতাহের ভাইয়ের ঘরে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আড্ডা করেছি অনেকবার। সেসময় একবার হলো কী? ভীষণ মল্ল হলো দুজনের মধ্যে। মাঠের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ আহমদ ছফার সঙ্গে একাডেমিক পণ্ডিত হুমায়ুন আজাদের ঐতিহাসিক বিতর্ক-টক্কর উদযাপন করলাম আমরা। সেই বিতর্ক দুজনের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে একটি রণ-রূপ পরিগ্রহ পেয়েছিল। রাজু আলাউদ্দিন একদিন সাক্ষাৎকার নিতেন আহমদ ছফার, সাক্ষাৎকারের সব কথাবার্তাই থাকত হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে, পরদিন সাক্ষাৎকার দিতেন হুমায়ুন আজাদের, তাঁরও সব কথাবার্তা থাকত আহমদ ছফার বিরুদ্ধে। সাক্ষাৎকারের শিরোনামেও পরস্পরের প্রতি আক্রমণ শানানো থাকত। সপ্তাহতিনেক ধরে তখনকার সদ্য প্রকাশিত ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিনে সেই সাক্ষাৎকারের বিতর্ক ছাপা হচ্ছিল। হয়ত আগেরদিন হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল: ‘ছফা একটা পশু’। পরদিন ছফার পালা। ছফার সাক্ষাৎকারের শিরোনাম: ‘পরজন্মে পশুই হব, তবু হুমায়ুনের মত মানবজন্ম চাই না’ কিংবা ‘আমি হুমায়ুনের বউয়ের কাছ যাব’। হুমায়ুন আজাদের বউয়ের কাছে যেতে চাওয়ার কারণ, আহমদ ছফা হুমায়ুন আজাদের বউকে জিজ্ঞাসা করতে চান, ‘খচ্চরটার সঙ্গে এত বছর সংসার করলেন কী করে?’

কবি শামসুর রাহমানের কবিতার ওপর হুমায়ুন আজাদ একটি গবেষণাগ্রন্থ করেছেন; গ্রন্থের নাম ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’। শেষের দিকে অবশ্য গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে দেখেছি, শামসুর রাহমানের সঙ্গেও হুমায়ুন আজাদের বিরোধ চলছে। আবার মৃত্যুর পর ছফা ভাইয়ের লাশ যখন টিএসসিতে রাখা ছিল, হুমায়ুন আজাদকে সেখানে ব্যথিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখেছি প্রায়ই বিকেলবেলা হুমায়ুন আজাদ শৌখিন বাইসাইকেল চালাচ্ছেন এবং আমরা তখন উদ্যানের ঘাসের উপরে বসে বন্ধুরা পাতা পুড়িয়ে খেতাম। আমাদের চোখ লাল হয়ে উঠত। এইসময় একদিন হুমায়ুন আজাদ বাইসাইকেল চালিয়ে আমার কাছাকাছি এসে থামলেন এবং আমাকে প্রশ্ন করলেন- এই অবস্থা! তুমিও চোখ লাল করে বসে আছো?

একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে সরকারি মদদে পুলিশ রাতের বেলা অনেক ছাত্রীকে নির্যাতন করে কিছু ছাত্রীকে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন প্রতিবাদস্বরূপ হুমায়ুন আজাদই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক, যিনি গোলাপফুল নিয়ে থানা হাজতে যেতে চান। শাহাবাগের মোড়ে পুলিশ হুমায়ুন আজাদকে বাধা দিলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ছাত্রীরা যে হাজত খানায় সারারাত দুর্ভোগে কাটিয়েছে, সেখানে আমি গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দিতে চাই।’ আমার প্রথম কবিতার বইটি প্রকাশিত হলে স্যারকে এক কপি পড়তে দিই। কয়েকদিন পর স্যারের সঙ্গে ক্যাম্পাসের কোথাও দেখা হলে তিনি বললেন, ‘পড়েছি তোমার লেখা। শুধু শব্দপুঞ্জ, একটিও বাক্য নেই।’ আমার সেই বইয়ের বেলায় স্যারের কথাটি খুবই ঠিক, পরে ভেবে দেখেছি।

মনস্বী হুমায়ুন আজাদের প্রজ্ঞার পূর্ণ ছাপ পাই তাঁর প্রবচনগুচ্ছতেও। লিখলেন ‘নারী’। সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলো। মামলা চলল। বিচারে জিতল ‘নারী’। আমরা দেখলাম, হুমায়ুন আজাদ স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছেন। সামাজিকভাবে খুব প্রাচীন চিন্তায় আবিষ্ঠ মানুষগুলো তাঁকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। অবস্থা এমন দাঁড়াল, হুমায়ুন আজাদ প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল মনে করে- হুমায়ুন আজাদ পণ্ডিত, ভাষাবিজ্ঞানী, মানবচিন্তার মুক্তির দিশারী, নিয়ত সৃষ্টিশীল, কবি, ভীষণ সাহসী এবং প্রথাবিরোধী লেখক। অন্যদল মনে করে- তিনি আত্মঅহঙ্কারী, প্রথাগত ধর্মীয় সংস্কৃতিতে অবিশ্বাসী, তাঁর বিচার হওয়া উচিত। যারা তাঁর লেখা তেমন পড়েনওনি, তারাও জানত, হুমায়ুন আজাদ বলে একজন অধ্যাপক আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমার হুমায়ুন আজাদকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর পাণ্ডিত্যের কাছে আমার চিরকাল শেখার আছে। একই ক্যাম্পাসে তাঁকে পেয়েছি বলে হয়ত তাকে যথার্থ মূল্যায়নের যোগ্যতাই আমার বা আমাদের হয়নি। চাপাতির কোপ তাঁর মুখ রক্তাক্ত করে দিয়ে গেছে- হুমায়ুন আজাদের লেখা কালো অক্ষরের শব্দ বাক্যের এমনি ক্ষমতা। মুখ দুইভাগ হওয়ার পরে হুমায়ুন আজাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আমার মুখের মতো দ্বিখণ্ডিত, দুই ভাগে বিভক্ত।’


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়