ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

দোররার আঘাতে প্রাণ গেল মৌসুমীর?

তানভীর হাসান তানু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দোররার আঘাতে প্রাণ গেল মৌসুমীর?

ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতা : ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় যৌতুক না পেয়ে এক গৃহবধূকে পরকীয়ার অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।

এ ব্যাপারে নিহতের বোন বাদী হয়ে সাতজনের নাম উল্লেখ করে গত ২১ ডিসেম্বর হরিপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।

বিয়ের পর থেকে যৌতুক নিয়ে স্বামী জাহাঙ্গীর আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে টানাপড়েন ছিল গৃহবধূ মৌসুমী আক্তারের। কয়েকবার মৌসুমীকে মারধর করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ গত ২০ ডিসেম্বর মৌসুমীর জীবনে ঘটে ভয়ংকর ঘটনা।

হরিপুর উপজেলার বালিয়াপুকুর গ্রামে পরকীয়ার অপবাদ দিয়ে ওই রাতে মাতব্বরদের নিয়ে সালিশ বসায় স্বামীর পরিবার। সালিশের রায় অনুসারে মোসুমীকে অনেক বার দোররা মারা হয়। এর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেলেও জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আবার চলে নির্যাতন। পর দিন ২১ ডিসেম্বর মারা যায় মৌসুমী।

মৌসুমীর মৃত্যুর পর তার স্বজনরা স্বামী জাহাঙ্গীর ও সালিশকারীসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ১০ জনের নামে হরিপুর থানায় ২০ ডিসেম্বর হত্যার অভিযোগ এনে এজাহার দেন। তবে পুলিশ গত শনিবার বিকেল পর্যন্ত হত্যা মামলা নেয়নি। এটিকে অপমৃত্যু মামলা হিসেবে নিয়েছে।

স্বজনদের চাপে মৌসুমীর লাশের ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নিলেও পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ নিহতের স্বজনদের। তবে পুলিশ জানান, সালিশকারীদের অন্যতম কাজী আবুল কালামকে অপমৃত্যু মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযুক্ত বাকিরা পলাতক আছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

মৌসুমীর স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, নয় মাস আগে বালিয়াপুকুর গ্রামের মৃত সাদেকের বড় ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে একই উপজেলার আমগাঁও ইউনিয়নের খামার এলাকার মৃত হবিবর রহমানের ছোট মেয়ে মৌসুমীর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় জাহাঙ্গীরকে যৌতুক হিসেবে নগদ ৩০ হাজার টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়। কিছু দিন যেতে না যেতেই জাহাঙ্গীর যৌতুক হিসেবে মৌসুমীর পরিবারের কাছ থেকে এক লাখ টাকা দাবি করে। এ জন্য জাহাঙ্গীর মধ্যে মধ্যে মৌসুমীকে মারধর করে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।

মৌসুমীর বড় ভাই জিন্নাত বলেন, এক লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে গত ১৬ ডিসেম্বর মৌসুমীকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় জাহাঙ্গীর। তখন মৌসুমী বাপের বাড়ি চলে আসে। এরপর মৌসুমীর পরিবারের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরকে জানানো হয় ধীরে ধীরে তারা এই টাকা দেবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর তাতে রাজি হয়নি, একসঙ্গেই চাইছিল। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর কৌশলে মৌসুমীকে তার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সালিশ বসায়।

সালিশে গ্রামের কাজী আবুল কালাম, আব্দুল কাদের, সাবেক ইউপি সদস্য জামালসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

সালিশের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ১১টায় জাহাঙ্গীরের বাসায় সালিশ বসিয়ে কাজী আবুল কালামের নির্দেশে ‘ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক’ মৌসুমীকে তওবা পড়ানো হয়। এরপর অনেকবার দোররা মারা হয়। তখন মৌসুমীর চিৎকারে তিনি ও আশপাশের অনেকে ছুটে আসেন। কিন্তু গ্রাম্য মাতব্বরদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।

ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নির্যাতন সইতে না পেরে মৌসুমী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কিন্তু জ্ঞান ফিরলে আবার দোররা মারা হয়। এরপর অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা বিনা চিকিৎসায় পর দিন মৌসুমী ওই বাড়িতেই মারা যায়।

মৌসুমীর দুলাভাই আবেদ আলী বলেন, ঘটনা ধামাচাপা দিতে মৌসুমীর পরিবারকে জানানো হয় সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। অথচ যেদিন মৌসুমীর মৃত্যু হয়, সেদিন স্থানীয় সারের ডিলার রফিকুলের দোকানে বৈঠক করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন আবেদ আলী।

মৌসুমীর বড় বোন হাসিনা বেগম ও ফিরোজা বেগম অভিযোগ করেন, যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় মৌসুমীকে নির্যাতন করে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত স্বামী জাহাঙ্গীর ও তার পরিবারের লোকজন।

ফিরোজা বেগম বলেন, মৌসুমীর মৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামী জাহাঙ্গীর, দেবর হাসিবুল,  কাজী আবুল কালাম, আব্দুল কাদের, সাবেক ইউপি সদস্য জামাল, মো. তরিকুল ও মৌসুমীর চাচী মোছা ফরকুন বেগমের নাম উল্লেখ করে ২১ ডিসেম্বর হত্যা মামলার এজাহার দেন। কিন্তু পুলিশ অপমৃত্যু হিসেবে মামলা নিয়েছে।

আমগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পাভেল ইসলাম বলেন, তিনি প্রথমে ঘটনা জানতেন না। পরে জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, দেশে আইন-কানুন থাকতে এভাবে দোররা মেরে সালিশ করা দণ্ডনীয়। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ২৩ ডিসেম্বর মৌসুমীর লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, মৌসুমীর শরীরে দোররার আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

এ ব্যাপারে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সুব্রত কুমার সেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ঘটনায় মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

হরিপুর থানা ওসি রুহুল কুদ্দুসের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ জানান, তিনি এ ঘটনা জানতেন না। কিছু মাধ্যমে জানতে পেরে অভিযুক্ত কালাম কাজীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে কালামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় যত প্রভাবশালী ব্যক্তিই জড়িত থাকুক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।



রাইজিংবিডি/ঠাকুরগাঁও/২৮ ডিসেম্বর ২০১৭/তানভীর হাসান তানু/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়