ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অবুঝ প্রেমের নির্মম পরিণতি!

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ১৬ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অবুঝ প্রেমের নির্মম পরিণতি!

এ কেমন প্রেম? বিয়ের প্রস্তাবে পরিবারের সদস্যরা রাজি না হওয়ায় প্রেমিকাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে টানা ১১ দিন ধর্ষণ করে আশিক।

আশিকের কবল থেকে সাময়িক মুক্তি পেলেও সেই যন্ত্রণা কিছুতেই ভুলতে পারছে না নাবালিকা প্রেমিকা।

ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৮ সালে রাজধানীর বংশালে। তখন প্রেমিকার বয়স ছিল ১৭ আর প্রেমিক আশিকের ২৪।

আশিকের মন ভুলানো কথায় মজে যায় ১৭ বছরের সেই কিশোরী। কিন্তু সে কল্পনাও করতে পারেনি তার জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে। 

জানা যায়, আশিক স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে নানা প্রক্রিয়ায় ৮ম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাতো। ঘটনার ধারাবাহিকতায় ওই ছাত্রী তার আহবানে সাড়াও দেয়। দুজনের মাঝে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। যেহেতু আশিক ছিল যুবক, তাই তার চাহিদা ছিল শারীরিক।

অন্যদিকে, প্রেমিকা নাবালিকা হওয়ায় সে বুঝতো না। তাই আশিক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তখন প্রেমিকা জানান, পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে। পরিবার চাইলে সে বিয়ে করতে রাজি আছে। কিন্তু ওই ছাত্রীর পরিবার বিয়েতে রাজি না হওয়ায় আশিক ক্ষিপ্ত হয়ে প্রেমিকাকে তুলে নিয়ে যায়।

পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করা হয় এবং আশিকসহ চারজনের বিরুদ্ধে অপহরণ পূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করে ভিকটিমের পরিবার। মামলায় আশিকের পাশাপাশি তার বোন মোছা. আশা, তার স্বামী শাওন ও আশিকের বন্ধু ফরহাদকে আসামি করা হয়।

বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন ওই কিশোরীর মা। মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক কাজী আব্দুল হান্নানের আদালতে বিচারাধীন। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

কিশোরীর মা জানান, মামলার দুই বছর হয়ে গেলেও বিচার পাচ্ছি না। আবার আসামিও জামিন পেয়ে গেছে। ন্যায়বিচার চাই, ওর সাজা হোক। যেটা দেখে আর কেউ যেন কারো জীবন নষ্ট না করে। অবুঝ কিশোরীদের যারা প্রেমের ফাঁদে ফেলে তারা যেন ভয় পায় এমন সাজা চাই। আমি চাই না, অবুঝ প্রেমের বলি হয়ে আর কোন মেয়ের জীবন নষ্ট হোক।

তিনি আরো বলেন, মামলা তুলে নিতে আসামির স্বজনরা হুমকি-ধামকি দেয়। আর আসামি যা করেছে সমাজে কিভাবে মুখ দেখাবো?এজন্য নিজের বাসা ছেড়ে অন্য এলাকায় ভাড়া বাসায় আছি। মেয়েকেও স্কুল পরিবর্তন করিয়ে এনেছি। এঘটনার পর আত্মীয়-স্বজনকে পাঠিয়ে তা আপোষের চেষ্টা করি। কিন্তু আসামিপক্ষ মেয়েকে বিয়ে করতে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। এত টাকা দেয়ার সামর্থ আমার নেই। এখন অপেক্ষায় আছি বিচারের। তার যেন সর্বোচ্চ সাজা হয়।

ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী বলেন, ও (আসামি) মানুষ না। ওকে বিয়ে করলে সুখী হবো না। ওরা আমাকে খেতে দেয়নি, অনেক নির্যাতন করছে। আমার জন্য ওর কিসের ভালবাসা। ও আমাকে ভালবাসলে এমনভাবে নির্যাতন করতে পারতো না। মেরে মেরে  আমাকে অসুস্থ করে ফেলেছে। আমি ওর সর্বোচ্চ সাজা চাই। ও যেন আর কোন মেয়ের সর্বনাশ করতে না পারে।

সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের প্রাবলিক প্রসিকিউটর এমএ আব্দুল বারী জানান, মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে। রাষ্ট্রপক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়। ভিকটিমের পরিবার যেন ন্যায় বিচার পায়।

আসামির জামিনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলাটি অজামিনযোগ্য। আসামিকে জামিন দেয়ার এখতিয়ার আদালতের। আদালত চাইলে জামিন দিতে পারেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। তবে মোবাইলে তিনি কিছু বলতে চাননি।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ভিকটিমের সঙ্গে আশিকের প্রেমের সম্পর্কের জেরে অপর আসামিদের সঙ্গে তার কথা হতো। সম্পর্কের একপর্যায়ে আশিক ভিকটিমকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়ায় ভিকটিম আসামিকে তার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। ২০১৮ সালের ২০ জুলাই ভিকটিমের মা-বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয় আসামিরা। ভিকটিম প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়ায় বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।

এতে আসামিরা ভিকটিমের পরিবারকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করে এবং ভিকটিমকে তুলে নেয়ার হুমকি দেয়। ২৭ আগস্ট ভিকটিম তার নানার বাসায় বেড়াতে যায়। আসামি আশিক ভিকটিমকে ফোন দিয়ে তার অবস্থান জেনে নেয়। 

বিকেল ৪টার দিকে ভিকটিম নানার বাসা থেকে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বংশালের বাওয়ানী স্কুলের সামনে থেকে আশিক ও তার বোন আশা ভিকটিমের গতিরোধ করে। তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ভিকটিমকে আশার বাসায় নিয়ে যায়। ভিকটিম আসামি আশা ও তার স্বামী শাওনের হাত পা ধরে কান্নাকাটি করে বাসায় পৌঁছে দিতে বলে।

আসামিরা বলে, তোর বাবা-মা তোকে আশিকের সঙ্গে বিয়ে দিবে না। তোকে বিয়ে ছাড়াই আশিকের সাথে সহবাস করতে হবে। আশিক ২৭ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ভিকটিমকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।

এদিকে ভিকটিমের মা-বাবা তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে। পরে আসামিরা বলে, আশিকের সঙ্গে ভিকটিম আছে। তবে তাদের অবস্থান জানায় না । ভিকটিমের পরিবার থানায় মামলা করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নেয় না। পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় ১১ সেপ্টেম্বর ভিকটিমকে তার বাবা-মা ফিরে পায়। ভিকটিমকে ধর্ষণ করার সময় আসামি আশিক ও তার বন্ধু ফরহাদ ভিডিও ও ছবি তোলে।

থানা মামলা না নেয়ায় ১৮ সেপ্টেম্বর ভিকটিমের মা আদালতে চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুজ্জামান শরীফ মামলাটি তদন্ত করে আশিককে একমাত্র অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। অপর তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের অব্যাহতির আবেদন করা হয়।

২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন আমলে গ্রহণ করেন আদালত। আসামি পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ৯ম দিনের মাথায় বংশাল থানা পুলিশ আশিককে গ্রেপ্তার করে।

গত বছরের ১৮ মার্চ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। প্রায় ১০ মাস পর এ আসামিকে ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিনের আদেশ দেন। আগামি ২৫ মার্চ মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।


ঢাকা/বুলাকী

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়