ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বৈশাখী মেলার সেকাল-একাল

কিসমত খোন্দকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৈশাখী মেলার সেকাল-একাল

জীবনের যতগুলো আনন্দ অনুষ্ঠান বাঙালি-জীবন স্মৃতিময় করে তোলে তার মধ্যে ‘বৈশাখী মেলা’ অন্যতম। একসময় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ প্রতিটি মানুষ বছরজুড়ে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করতো। ঘরে ঘরে চলতো নানা আয়োজন। নতুন পোশাক, পিঠাপুলি বানানো, নিজ নিজ গৃহ নানাভাবে সাজানো। গ্রামের মাটির ঘরগুলো সুন্দর করে লেপন করা হতো, তাতে আঁকা হতো নানা চিত্র। সেখানে ফুটে উঠতো গ্রামীণ জীবনের নানা দিক। এ জন্য গাছের ছাল-বাকল দিয়ে রং তৈরি করা হতো।

চৈত্রের শেষ দিনে চড়কপূজার মাধ্যমে বৈশাখের সূচনা হতো। চড়কপূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব। বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়কপূজার উৎসব চলে। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা ‘চৈত্রসংক্রান্তির মেলা’ নামে অভিহিত।

আমার শৈশব কেটেছে গ্রামীণ পরিমণ্ডলে। এখনো শৈশবের স্মৃতিগুলো তাড়িয়ে বেড়ায়। বৈশাখী মেলা সার্বজনীন অনুষ্ঠান হিসেবেই পালন করতে দেখেছি; পালনও করেছি। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় আমার জন্ম। সঙ্গত কারণে আমার বন্ধুত্বও তাদের সঙ্গে বেশি ছিলো। বৈশাখী মেলায় বেশির ভাগ সময় ওদের সঙ্গেই কাটাতাম। মেলার আগে নতুন জামা আর খেলনা কেনার জন্য বিশেষ মঞ্জুরী পেতাম মা আর বড়ো ভাইয়ের কাছ থেকে। পড়ালেখায় অমনোযোগী হলেই মা হুমকি দিতেন পড়তে না বসলে মেলার জন্য পয়সা পাবে না। এতে বেশ কাজ হতো। সব ফেলে শুদ্ধ ছেলে হয়ে যেতাম। সব দুষ্টুমি আর ডানপিটেপনা বন্ধ হয়ে যেতো। আমাদের পরিবারে পহেলা বৈশাখ এক অন্যমাত্রা এনে দিতো। কেননা এই দিনে আমাদের পরিবারের সবচেয়ে প্রিয়পাত্র আমার প্রয়াত বড়ো ভাই খন্দকার আল-মহসীনের জন্মদিন পালিত হতো। ফলে বাড়িতে এমনিতেই নানা আয়োজন থাকতো। সে উপলক্ষ্যে মির্জাপুরে আমাদের বাড়িতে বিশেষজনেরা একত্রিত হতো। কাজেই সন্ধ্যার পর বাসাতেই কাটাতে হতো। তবে সারা দিনের কর্মচাঞ্চল্য আপ্লুত করে তুলতো।

পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো আমাদের এলাকার ব্যবসায়ীদের দোকানে হালখাতা। হালখাতা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। ‘শুভ হালখাতা’র কার্ডের মাধ্যমে ওই বিশেষ দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হয়। এ উপলক্ষ্যে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ অনুযায়ী পুরনো দেনা শোধ করেন। অতীতে ব্যবসায়ীরা লাল কাপড়ে মোড়ানো একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিন নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। এই হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকেই ‘হালখাতা’র উদ্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোটো-বড়ো-মাঝারি যে কোনো দোকানেই এটি পালন করা হয়ে থাকে। মূলত পহেলা বৈশাখ সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন এই কামনায় যে, তাদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভালো হয়। দেবতার পূজার্চনার পর তার পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুরে স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কিত ও চন্দনচর্চিত খাতায় নতুন বছরের হিসাব-নিকাশ শুরু করে। এদিন গ্রাহকদের আপ্যায়নে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, লুচি, মালপোয়া, পানতোয়া, ফল পরিবেশন করা হতো। এটিও ছিলো আনন্দের অন্যতম বিষয়। বছরজুড়ে কোনো দোকান থেকে বাকি সদাই না করলেও প্রভাবশালী পরিবার এবং বড়ো ভাইয়ের কারণে স্থানীয় সব মহাজন এবং অন্যান্য দোকান থেকে দেবী লক্ষ্মী ও দেবতা গণেশের ছবি আঁকা হালখাতার কার্ড আসতো আমাদের বাড়ি। আর সেগুলো আমি গুছিয়ে রাখতাম। হালখাতার ২/৩ দিন আগে সেগুলো বড়ো ভাইয়ের হাতে তুলে দিতাম। তিনি বেছে বেছে কোন কোন দোকানে আমি যাবো আর কোন  দোকানে পরিবারের অন্যরা যাবে তা ঠিক করে প্রয়োজনীয় টাকা তুলে দিতেন। না, আমি একা যেতাম না, সঙ্গে আরো তিন-চারজন বন্ধুকে নিয়ে যেতাম। দোকান মালিক আর কর্মচারীরা আমাদের ভালো করে চিনতেন, ফলে বিশেষ সমাদরও পেতাম।

পহেলা বৈশাখের সকালে ইলিশ-পান্তা দিয়ে দিনের যাত্রা শুরু হতো। মির্জাপুর লৌহজং নদীসংলগ্ন সাহাপাড়া দালানবাড়িতে থাকতেন আমার প্রিয়বন্ধু এবং মহেড়া জমিদারবাড়ির ছেলে মৃদুল কুমার রায় চৌধুরী। ওর দিদিমা জোতির্ময় রায় চৌধুরী ছিলেন বালিয়াটি জমিদারের মেয়ে। যার আদর আর স্নেহ নিজের নানী-দাদির অভাব পূরণ করেছিল। জীবদ্দশায় যতদিন বাংলাদেশে ছিলেন, ততদিন তিনি আমাদের শত অত্যাচার মাথা পেতে সহ্য করেছেন। দিদিমা আমাদের জন্য বিশেষভাবে নাড়ু, মোয়া, ক্ষিরশার সন্দেশসহ নানা পদের খাবার সারাবছরই খাওয়াতেন। তবে পহেলা বৈশাখে তার হাতের নানা সুস্বাদু খাবার আমাদের রসনা তৃপ্ত করতো। দুপুরের ভোজ সারতাম বন্ধু উত্তম কুমার সেনের (বিপ্লবী সূর্য সেনের আত্মীয়) মা প্রিয়সন্ধ্যা সেন দিদির রান্না করা প্রায় পঞ্চাশ  পদের খাবার দিয়ে। এসবই এখন স্বপ্নাতীত।

হ্যাঁ, পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা জানাতে নিজ হাতে বানানো শুভেচ্ছা কার্ড এখন আর দেয়া হয় না। তবে মনে পড়ে বৈশাখ আসার পনেরো দিন আগে থেকে আর্টপেপার আর রেইনবো কালার বক্স কিনে কার্ড বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। এই কার্ডগুলো নিয়ে আমার বাড়িতেই প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন আমার বড়ো ভাই। থাকতো পুরস্কারের ব্যবস্থা। ওই অনুষ্ঠানগুলোতে ঢাকা থেকে কখনো কবি কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু কবি জুলফিকার হায়দার, কবি আল-মুজাহিদী, কখনো প্রয়াত সাংবাদিক ও কবি এবং আমাদের পারিবারিক বন্ধু অরুনাভ সরকার উপস্থিত থাকতেন। প্রতিবারই আমি পুরস্কৃত হতাম বলে কোনো কোনো সময় বড়ো ভাই বিরোধিতা করতেন অন্যকে উৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু বিচারকদের বিচারে আমি প্রথম হতাম। এসবই এখন প্রযুক্তি দখল করে নিয়েছে। পহেলা বৈশাখে গ্রামীণ মেলাগুলো এখন খুব মিস করি। মাটির ব্যাংক, ঘোড়া, হাতি, সিংহ, বাঘসহ রকমারি পণ্যের দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপন এখন  আর তেমন দেখতে পাই না। তবে এখনো মির্জাপুরের সরিষাদাইড়, মহেড়া জমিদারবাড়ি প্রাঙ্গণ, জামুর্কি, ভাদগ্রাম, দেওহাটা, ওয়ার্সীসহ অনেক জায়গায় বৈশাখী মেলা হলেও সেই আগের প্রাণ আর নেই। মেলার মুড়ি-মুরকি, মোয়া, বিন্নি ধানের খই, সাজ (চিনির তৈরি হাতি, ঘোড়া, ঝাউ গাছ, বট গাছের আকৃতির তৈরি এক ধরনের শুকনো মিষ্টি), জিলাপির উপর মৌমাছির গুনগুন শব্দটা এখনো কানে ভাসে। ছোটো ছোটো মেয়েরা বেদেদের ঝুড়িতে রাখা নানা আকৃতির চুড়ি কিনে রিনিঝিনি শব্দ করে মেলার মাঠ শব্দময় করে দিতো। মেলায় শুধু আনন্দ হতো তাই নয়, বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্য হতো সেটাও অনেক বড়ো বিষয় ছিলো।

বৈশাখী মেলা বহুদিন থেকে ভারত উপমহাদেশে পালিত হচ্ছে হয়তো অনাদিকাল চলবে। যুগের পর যুগ একইভাবে চললেও বর্তমানে এই মেলাগুলো এখন করপোরেট হাউজগুলোর হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য বাজারজাত করতে তাদের ইচ্ছেমতো মেলা সাজাচ্ছে, ফলে বৈশাখী মেলার আদি রূপ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এখানেই বৈশাখী মেলা নিয়ে আমার শঙ্কা। এছাড়াও এখন পহেলা বৈশাখে উচ্চ শব্দে ভিনদেশি গান বাজায় অনেকে। এটি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। এদিন অনেক স্থানে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ঘটা করে ব্যান্ডসংগীতের আয়োজন করা হয়। পড়ে যায় চড়া দামে ইলিশ-পান্তা খাওয়ার হিড়িক। এর কোনোটিই আমাদের লোকসংস্কৃতির পরিচয়বাহী নয়।   



ইতিহাস থেকে দেখা যায়, সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মণিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘটা করে পালিত হতে দেখা গেছে। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমন ছিলো না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিলো কৃষিকাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো।

ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতে শুরু করে। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলতো না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা আনার লক্ষ্যে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিলো একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে নতুন হিসাবের খাতা খোলা বোঝানো হয়েছে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সালের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের এই ভূ-খণ্ডের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নানা বৈচিত্র্যময় কর্মসূচীর মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ পালিত হচ্ছে। যদিও উভয় বাংলার বৈশাখী মেলা এখন করপোরেট হাউজগুলোর কাছে বন্দি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ