ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

অন্তত সাইনবোর্ডের ভাষা বাংলা হোক

রেদ্ওয়ান আহমদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৬:৩৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
অন্তত সাইনবোর্ডের ভাষা বাংলা হোক

পৃথিবীতে কেবল একটি দেশ আছে, যে দেশটি কিনা তার সন্তানদের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশের স্বাধীনতার পথ তরান্বিত করেছে। কালক্রমে পেয়েছি এই স্বাধীন বাংলাদেশ। তবে, ভাষা সংগ্রামের ৬৯তম বছরে এসেও আমরা কি পেরেছি ভাষা শহীদদের সঠিক মর্যাদা দিতে? 

ভাষা আন্দোলনের মূল প্রাতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার’। কিন্তু আজও সে আন্দোলনে আমরা সফল হতে পারিনি। ফলে, আমরা ভাষা শহীদদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। মাতৃভাষা হলো প্রতিটি মানুষের আত্মমর্যাদার সর্বোচ্চ স্থান। কারণ, সে মানুষটির সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা ইত্যাদি সবকিছুর প্রকাশ ঘটে তার মাতৃভাষাতেই। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি দেশেই উচ্চশিক্ষা দেওয়া হয় তাদের নিজস্ব ভাষায়। তেমনি আমাদের প্রায় হাজার বছরের বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিস্ফুটন ঘটে বাংলা ভাষায়। 

আরো পড়ুন:

পরাধীন ভারতীয় ভূখণ্ডে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম কংগ্রেস সভায় বাংলায় বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে ভাষাগত আত্মমর্যাদা রক্ষা করেন। তারপর থেকেই বাঙালির এই বাংলা ভাষাটি ধীরে ধীরে বিশ্বের বুকে আলাদা করে জায়গা দখল করে নিয়েছে, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে নোবেল জয়ের মাধ্যমে আরো সুউচ্চ আসনে আসীন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে মানটা কি আমরা আদৌ ধরে রাখতে পারছি? নিশ্চয় উত্তর হবে ‘না’। কারণ, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৮৭ সালে সর্বস্তরে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ পাস হলেও আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অনেক কর্মকাণ্ডে বাংলা বাধ্যতামূলক করতে পারা সম্ভপর হয়ে ওঠেনি। এমনকি ১৯৮৭’র আইনটি বাস্তবায়নে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও লক্ষ করা যায় না। অথচ ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান সোপান। অবর্ণনীয় অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন ও শোষণের পর যার সূত্র ধরেই গঠিত হয় একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। 

সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার এই কয়জন ভাষা শহীদদের নাম আমাদের ঠোঁটের ডগায় থাকলেও মূলত ভাষা শহীদ কতজন, তা আজও স্পষ্ট করা হয়নি। এজন্য আগামী প্রজন্ম এভাবেই মাতৃভাষা ও ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার স্থায়ী রূপ দিতে না পারলে শুধু যে ভাষা শহীদদের অমর্যাদা করা হবে তাই নয়, প্রশ্নবিদ্ধ হবে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার চেতনা। বর্তমানে ভাষার অপব্যবহারে সবচেয়ে বেশি যে দিকটি ফুটে উঠছে, তা হলো ইংরেজি ভাষা শিক্ষার আধিপত্য। 

ইংরেজি শিক্ষা বা বিদেশি শিক্ষার স্থান যেখানে বাংলা ভাষার পরে রাখার কথা, সেখানে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশের অনেক উচ্চশিক্ষিতরা বাংলা শব্দের সঠিক উচ্চারণটা পর্যন্ত করতে পারেন না। সমাজের উঁচু শ্রেণির অধিকাংশ মানুষই আজ ইংরেজিমুখী। শুধু তাই নয়, ইংরেজিমুখী এই মনোভাব আজ উঁচু শ্রেণি থেকে নিম্ন শ্রেণি পর্যন্ত ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের ইংলিশ মাধ্যম, আরবি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবাধে বিদেশি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে উপেক্ষা করা হচ্ছে মাতৃভাষা বাংলাকে। ফলে দেশি শিক্ষার বিপরীতে ছাত্রছাত্রীরা শিখছে বিদেশি শিক্ষা ও সংস্কৃতি। 

আজকাল পথ-ঘাট, দোকান-পাট, ব্যানার-ফেস্টুন, সাইনবোর্ড ইত্যাদিতে অবাধে ইংরেজির বিচরণ দেখা যায়। যেটুকু আবার বাংলাকে উপস্থাপন করা হয় তাও বিকৃতরূপে। এমনকি আইনভবন অর্থাৎ সংসদেও সমানতালে চলছে ভাষা দূষণ। হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টেও এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা যায়নি দেশীয় ভাষার সম্পূর্ণ ব্যবহার। অন্তত সাইনবোর্ডের ভাষাটাও বাংলা মাধ্যম হয়নি।  

বাংলা একাডেমি কর্তৃক বাংলা শুদ্ধ বানান আন্দোলন, ভাষার মর্যাদা রক্ষা কর্মসূচি ও একুশ বইমেলার আয়োজন দেখতে পেলেও এসব কর্মকাণ্ড একাডেমি প্রাঙ্গণেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকে। বর্তমানে অনেক তরুণ লেখকদের বইয়ে ভাষার অন্যায্য ব্যবহারে মুক্তভাবে বিস্তার লাভ করছে ভাষা দূষণ। কয়েক বছর আগে তো ‘বাংলিশ’ ভাষায় এক লেখকেরও বই প্রকাশিত হয়েছিল। তরুণ প্রজন্মের লেখকদের বইয়ে ইংরেজি শব্দের মুক্ত গাঁথুনি স্পষ্ট পাওয়া যায়, সেদিকে যেন বাংলা একাডেমির কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। 

রেডিও স্টেশনগুলোতে ভাষার চলিত রূপ বিকৃত করে ব্যবহার করা হচ্ছে। অধিকাংশ অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে ‘হেল্লো লিসেনারস’ এবং শেষটা হচ্ছে ‘গুডবাই, বাববাই’ ইত্যাদি বাক্য দিয়ে। টিভি নাটক-সিরিয়াল এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন ভাষা দূষণ ও ভাষার অপব্যবহারের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সমানতালে। যেমন কেউ বলছে, ‘হোয়াটসঅ্যাপ ব্রু, ডে বাই ডে কেমন স্লিম হয়ে যাচ্ছো। রিডিং বেশি হচ্ছে নাক?’ এগুলো হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নিত্য ব্যবহৃত কথামালা। এমনিভাবেই অনেকে বাংলাতে কথা বলার সময় অযোগ্য ও অনুচিত উপসর্গ-অনুসর্গ ব্যবহার করে থাকে। 

বর্তমানে তো ভাষা দূষণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো ফেসবুক। বাংলা-ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু ভাষাগুলোকে একত্রে মিশ্রিত করে এমনভাবে জগাখিচুড়ি করা হচ্ছে যে তাকে আর বাংলা ভাষা বলা যায় না। বরং বাংলার অপভ্রংশই বলা চলে। এভাবে আমরা বাংলা ভাষাকে একদিকে যেমন বিকৃত করছি ঠিক সাথে সাথে ভাষা শহীদদেরও অমর্যাদা ও অসম্মান করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। মাতৃভাষার দিক থেকে বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থান পেলেও জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষার ৬ষ্ঠ স্থানেও জায়গা করে নিতে পারেনি এই ভাষা। 

আমরা যদি জাতিগতভাবে দেশের সর্বস্তরের বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তাহলে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষায় বাংলা ভাষার অধিভুক্তি নিয়ে আমাদের দাবি হবে যথেষ্ট অযৌক্তিক। ধারণা করা হয়, বর্তমানে যেভাবে ভাষার অপব্যবহার ও দূষণ হচ্ছে তাতে ২১০০ সালের মধ্যেই বাংলা ভাষা একটি পরাশ্রয়ী ভাষায় রূপ নেবে৷

অতএব, এসব সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্ত্বা হবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং দেশ হয়ে পড়বে বিদেশি ভাষা নির্ভর। বাংলা ভাষা হয়ে পড়বে স্বকীয়তাহীন, একইসঙ্গে আমরা হারিয়ে ফেলব বাঙালির হাজারো বছরের পুরনো সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য। এতে বাংলা ভাষা তার অস্তিত্ব সংকটে পতিত হবে। 

সুতরাং ভাষার এই অস্তিত্ব সংকট, অপব্যবহার ও ভাষার দূষণ থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে চাইলে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বাংলা ভাষাকে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলা একাডেমিকে ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকতে হবে, যেন সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভাষার অপব্যবহার ও অসচ্ছ ব্যবহার না হয়। এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অচিরেই বাংলা ভাষা আনায়ন করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষা চালু ও উচ্চশিক্ষা বাংলায় প্রদান করতে হবে। দোকান-পাটের নাম, ব্যানার-ফেস্টুন-সাইনবোর্ড, পোস্টার-লিফলেট ইত্যাদিতে ইংরেজি ভাষা ও বিদেশি ভাষা দূরীকরণে ‘শুদ্ধ ভাষা আন্দোলন’ জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি একযোগে দেশের উচ্চশ্রেণি থেকে নিম্নশ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে ‘সঠিক মাতৃভাষা শিক্ষা’র শপথ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই না বাংলা ভাষার মান সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং ভাষা শহীদদের মর্যাদার যথাযথ সংরক্ষণ হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

চবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়