অপরাজিতা পুষ্পে অপরাজিতার অর্চনা ॥ বিপ্রদাশ বড়ুয়া
বিপ্রদাশ বড়ুয়া || রাইজিংবিডি.কম
অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার
অপরাজিতা গাঢ় নীল রঙের একটি ফুলের নাম। আবার স্কন্দপুরাণে দেবী দুর্গার একটি মূর্তির নাম ‘অপরাজিতা’। আশ্বিনের শুক্লাদশমীতে একে ঈশান কোণে রেখে অপরাজিতা ফুল দ্বারা অর্চনা করলে গৃহীর মনোবাসনা পূর্ণ হয়। তাই আজও বাংলার তন্ত্রসাধকগণ শারদীয় দুর্গাপূজার কাজ শেষ করেন অপরাজিতা লতার বেষ্টনী ও ফুল দ্বারা।
আবার অথর্ববেদের রাজকল্পে আছে দুর্গ বিজয়ের পর নিজের বিজিত সীমানা চিহ্নিত করার জন্য অপরাজিতা রোপণ করে। ফুলটির নামই যে অপরাজিতা।
আবার অপরাজিতা-বিদ্যাটি এককালে মনীষীদের কাছেও খুবই মাননীয় ছিল। কালিদাস শকুন্তলা কাব্যে অপরাজিতা-বিদ্যা ও অপরাজিতা পুষ্পের উল্লেখ করেছেন।
অপরাজিতা-বিদ্যা দ্বারা দেবরাজ ইন্দ্র বৃত্র নামক অসুরকে বধ করেন। এই বিদ্যা হলো প্রথমে কপট উপায়ে ইন্দ্রকে বৃত্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে। মিত্রতাসূত্রে ইন্দ্রের প্রতি বৃত্রের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালে বিষ্ণু বজ্রের মধ্যে গুপ্তভাবে প্রবেশ করবেন। সেই বজ্রের আঘাতে ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করবেন। বজ্র হলো ইন্দ্রের অমোঘ অস্ত্র। অপরাজিতা-বিদ্যা হলো তাই দৈবের আশ্রয়ে চিকিৎসা। অর্থাৎ মন্ত্রতন্ত্র দ্বারা চিকিৎসা। এই বিদ্যা প্রাচীন কালে খুব মাননীয় ছিল। এখনও কোথাও কোথাও গুপ্তবিদ্যা হিসাবে প্রচলিত আছে।
এখন শারদীয় পূজা, মা দেবী দুর্গার আরাধনা। তিনি পরমপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবতাদের সমবেতভাবে উৎপন্ন তেজ হতে তিনি আবির্ভূত হন। সকল দেবতা তাঁদের নিজ নিজ অস্ত্রসমূহ এঁকে দান করেন। এভাবে মানব ও দেবতাদের অজেয় মহিষাসুরকে তিনি দমন করেন। সত্য যুগে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দুর্গামূর্তি প্রস্তুত করে তিন বছর পূজা করেছিলেন। ত্রেতাযুগে রাবণ চৈত্রমাসে বসন্তকালে এঁর পূজা করতেন। সেই জন্য এই পূজা বাসন্তী পূজা নামে খ্যাত। রাম অকালে দেবীর বোধন করে রাবণকে বধের জন্য এই পূজা করেছিলেন। মহিষাসুর ও রাবণ অশুভের প্রতীক। কিন্তু মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যে রাবণ ন্যায়পরায়ণ ও দেশপ্রেমিক রাজা। পুত্র মেঘনাদের মৃত্যুতে তাঁর পিতৃহৃদয়ের কান্না বিখ্যাত হয়ে আছে।
শারদীয় দুর্গা পূজায় প্রয়োজন সাদা অপরাজিতা। কিন্তু দুর্গা পূজায় সাদা জবা, সাদা ঝিন্টি, নীল অপরাজিতা, পীত ঝিন্টি, টগর, তুলসী, মন্দার, সাদা পদ্ম, তমাল, কুশ ও কাশ ফুল নিষিদ্ধ। লাল, গোলাপি ও নীল (হিমালয়ে উৎপন্ন) পদ্ম পূজায় লাগে। অনুসন্ধিৎসুদের জন্য এই নিষেধের তালিকা দেওয়া হলো।
আমাদের দেশে নীল, সাদা ও ক্বচিৎ বেগুনি-রঙের অপরাজিতা ফুল দেখা যায়। এক পাপড়ি ও দুই স্তর পাপড়ির এই ফুল হয়। পাশ্চাত্য উদ্ভিদবিদেরা বলেন, এই ফুল এসেছে মালাক্কা দ্বীপ থেকে। খুব প্রাচীনকালে এই দ্বীপ এশিয়াসহ অস্ট্রেলিয়া মিলে একটি মহাদেশে ছিল। টারনেটি বা মালাক্কা থেকে এসেছে বলে অপরাজিতার বৈজ্ঞানিক নাম ক্লিটোরিয়া টারনেটিকা। ক্লিটোরিয়া অর্থ যোনীপুষ্প। ফুলের ভিতরের আকৃতি দেখে এই নাম। কেরালায় একে বলে ‘শঙ্খপুষ্পী’। এই ফুলের বয়স অন্তত পাঁচ কোটি বছর। ঢাকার নার্সারি, বলধা গার্ডেন ও কোনো কোনো অফিসের বাগানে এই ফুল আছে।
নীল অপরাজিতা বরো মাস ফোটে। তবে শীতে কমে যায়। নীল ফুলের গাছ যত তাড়াতাড়ি শাখা-প্রশাখা ছড়ায় সাদা তত তাড়াতাড়ি নয়। মূর্ছায়, শূল ব্যথায়, ভূতের ভয়ে উন্মাদে, গলগণ্ডে, ঘন ঘন প্রস্রাবে, মেধা বৃদ্ধিতে, স্বরভঙ্গে, শুকনো কাসিতে, আধকপালে বেদনায়, খোস-পাঁচড়ায়, মেহে ও শোথে অপরাজিতার মূল, পাতা বা ডাল ওষুধের কাজ করে। কবিরাজেরা এটা জানেন। আমরা এ নীল রঙের বৈভবে মুগ্ধ। অপরাজিতা নামটিও সুপ্রাচীন ও মাধুর্যে অজেয় বা অদ্বিতীয়া।
নীল রঙের ফুল আমাদের দেশে ও বিশ্বে লাল, সাদা, গোলাপি, গাঢ় লাল ইত্যাদি ফুল থেকে কম। পৃথিবীর বিবর্তনের ধারায় নীল রং এসেছে সবার শেষে। সাধারণত পাখির পালক পোকামাকড় ও কিছু কিছু প্রজাপতির পাখায় নীল রং দেখা যায়, একটু বেশি থাকে উষ্ণ মণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রজাপতির পাখায়। পাখির পালক ও ফুলে নীল রং সবার শেষে এলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের শেষে নীল রং এসেছে। এই অনুমান ও বিশ্লেষণ মানুষই করেছে, সত্য এবং মিথ্যা দুইই হতে পারে, তারপরও রঙের রাজ্যে নীল এখনও অপরাজেয়, তার রঙের খাঁটি গভীরতা সবার মনে দোলা জাগায়। আর সম্ভবত উদ্যানবিদ্যায় নীল গোলাপ ও নীল চন্দ্রমল্লিকা ফোটাতে এত কঠিন বলেই হয়তো এতসব ভাবা হচ্ছে। আকাশি নীল রং এখনও আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর ও চক্ষুবিনোদনকারী। ঝকঝকে উজ্জ্বল নীল ছাদ ও দেয়াল- বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতার জন্য এখনও আদর্শ। নীল সিলকের খাঁটি চিনে কাপড় সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে খুব আদরণীয়। নীলবসনা, গভীর নীল সমুদ্র মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে। তবে নীল পাহাড় কখনও কখনও ভৌতিক রহস্য মনে জাগায়।
কৃষ্ণ ও রামের গায়ের রং নীল। শনির দেবতার রং নীল। নীল চোখের আকর্ষণী শক্তি প্রবল। নীল রং আনুগত্যের প্রতীক। নীলি লাজুলির (জাকারাণ্ডা মাইমোসিফোলিয়া) পাতা লজ্জাবতীর পাতার মতো ও একই গোত্রের। ছোট ছোট তার পাতা। পত্রদণ্ডের কোলে ফোটে তার বাহারী নীল ফুল, চোখ জুড়িয়ে দেয়। এক পাপড়ির অপরাজিতার গাঢ় নীল রঙের বিপরীতে ভেতরে আছে ম্লান নীল। গাছে সারের অভাবে নীল রঙের ঝলক কমে যায়। আর যৌবনে তার উদ্ভাসও হয় সেরকম গভীর ও উন্মাদনাকারী। এই উদ্ভিন্ন সুন্দরীকে আপনি টবেও চাষ করতে পারেন, তারপর একটি ফুল খোঁপায় উৎসর্গ করলে আপনিও অপরাজিতা হয়ে উঠবেন।
দেবী অপরাজিতাকে বন্দনা করা হয় শক্তি লাভের জন্য, দুর্গতি নাশের জন্য, অপরাজিতা বা অপরাজিতা হওয়ার জন্য নয় কি? দেবী অপরাজিতা আমার প্রিয় দেবী- তাঁর শক্তির প্রতীক দশ হাতের জন্য। অমন দশ হাত যদি থাকত! শুধু লিখতাম আর লিখতাম। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-গান-নাটক-চিঠি... শরৎ হেমন্ত থেকে বাসন্তী পূজা পর্যন্ত... দেবীর জন্য স্তোত্র লিখে ভাসিয়ে দিতাম শিউলী ফোটা শরৎ...। ত্রিনয়নী দুর্গার রূপের সীমায়ও বশীভূত আমি। তিনি দেবী, তিনি মানবী, তিনি আদ্যাশক্তি। গভীর রাতে ও ভোর-রাতে দূর থেকে যখন আরতির সুর ভেসে আসে; বাংলাদেশের ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল, মন্দিরা ও কাঁসর ঘণ্টার ঐকতান ভেসে আসে শরৎ পাড়ি দিয়ে; স্তোত্র পাঠ হয় সুর করে- ঘুম ভেঙে যায় আরতি-সঙ্গীতে...! আমার গ্রামখানিতে, আমাদের হারানো শৈশবের স্মৃতি-পারাবার পেরিয়ে... মনে পড়ে!!
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪/তাপস রায়
বিশেষ রচনা