অপেক্ষায় আছি || ড. তানভীর আহমেদ সিডনী
ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম
অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার
এক.
রিকশার বেল বাজে। রিকশা ব্রেক কষে থামে। রিকশাওয়ালা তাঁর বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে-
বন্ধু : ও মোতালেব মিয়া, কই যাও?
রিকশাওয়ালা : সদরঘাট যামু, ঐহানে শাড়ি পাওয়া যায়। পাবনার শাড়ি কিনতে যামু।
বন্ধু : তোমাগো ঐখানে যে আমার লেইগা ঘর খুঁজতে কইছিলাম হের কী করলা?
রিকশাওয়ালা : নতুন ঘর পাইলাম না। আমার জন্যে ঘরটা ঠিক কইরা নিছি।
বন্ধু : বউরে কবে আনবা?
রিকশাওয়ালা : কবে আনবো মানে? কাইল বিয়ানে বউ আমার ঢাকায় আসবো।
বন্ধু : যাউক! আমার তো ঘর খুঁজতে যাইতে অইবো।
রিকশাওয়ালা : লও যাই। আমার রিকশায় ওঠো তুমি। নামায় দিমুনে
মিউজিক
দুই.
রিকশাওয়ালা আর তার স্ত্রী কথা বলতে থাকে-
রিকশাওয়ালা : চাঁনখারপুল থেকে নয়াবাজার। আমার রিকশা চলে ধুন্ধুমার। যাত্রী পেলে হয়, আমি ছুটে চলি। ডান-বাম না থেমে চলতে থাকি। এই শহরে আমি আর আমার রিকশা। না না থুক্কু আর থাকবে অন্য আরেকজন। তার কথা কইতে গেলে বুক ধুকপুক করে। কাঁপন লাগে শরীরে।
তার কথা মনে আসলে বুকটা তিরতির করে। সে আজই আমার ঘরে আসছে। সারাদেশে মিছিল-মিটিং। আর আমার ঘরে. আমার মনে সে বসে থাকে। কানের কাছে ডাক দেয় ময়না। তার ডাকে মন উদাসী হয়। উথাল-পাথাল করে বুক। তবে কি সে আমার অন্তরে ঠাঁই নিয়েছে? আয়না আমার সই। তুই চারদিক উজালা করছস।
নারী : আমার শরম করে।
রিকশাওয়ালা : দিনে একটা ট্রিপ বেশি মারুম। সেই ট্রিপের টাকা জমাইয়া তোর নাকের ফুল গড়াইয়া দিমু। তুই আমার বুকে মাথা ঘষবি আর কইবি, লাগবো না কিছু।
নারী : কিছুই চাই না, আমাগো সংসারে যেন একটু সুখ থাকে।
রিকশাওয়ালা : সুখ অইবো। ঐ নৌকাওয়ালারা কইছে সুখ আইবো, বাঙালিরা ক্ষমতায় আইলেই সুখ।
নারী : আমি রাজনীতি বুঝি না। বুঝি শুধু একমুঠো ভাত আর শান্তির ঘুম। আমি তোমার বিয়া করা বউ। সুখ দিবা, আদর দিবা।
রিকশাওয়ালা : জব্বর শব্দ। বিয়া করা বউ। শোন বউ, কাইল বিয়ানে তোরে লইয়া শহরে ঘুরমু। মাঝ রাইতে বাইর অইয়া জমার টেকাটা উঠাইয়া ঘরে আসুম। তারপর আমি তুই, চিনাবাদাম...
নারী : হাঁচাই যাবা?
রিকশাওয়ালা : হ কাছে পিঠে কয়টা যাত্রী ওঠায়া দিনের খরচ তুইলা আনুম। তারপর তোরে লইয়া উড়াল দিমু। রাজকন্যার গানটা তাইলে তোরে শোনাই।
নারী : আহা দেরি অইয়া যাইবো।
রিকশাওয়ালা : তোরে গান শুনানোর লাইগা না হয় দেরি হউক।
নারী : আইচ্ছা।
রিকশাওয়ালা : রাজকন্যা গেলা এক গাছের আড়ালে।
তারারে রাখিয়া চাঁন্দ যেন অস্তাচলে ॥
মন না যাইতে চায় পালটে আঁখি।
এহিত না ভিন্ন দেশী কুমারের দেখি ॥
দেখিয়া সুন্দরি কন্যা ভাবে মনে মন।
কবি কঙ্ক কহে হৃদে বিন্দিল মদন ॥
নারী : রাজার কুমার দেখে জাগিয়া স্বপন।
সম্মুখে তাহার এক অপ্সরা কানন ॥
চারিদিকে নৃত্য করে অপ্সরা সকলে।
কেহ গায় গীত কেহ নাচে তালে তালে ॥
জাগিয়া উঠিলা রায় নৃত্যগীত শুনি।
মনে যে বাজিয়া উঠে নূপুরের ধ্বনি ॥
[বিদ্যা সুন্দর, কবি কঙ্ক।]
রিকশাওয়ালা : সেই ছোট্টবেলায় আমাগো গেরামে পালা গাইতে আইছিল। শীতকালে খড়ের উপর বইসা শুনছিলাম পালা। ভুলি নাই, পালার গানগুলি ভুলি নাই। তুইও দেখছি গান পারস, জানলি কেমনে?
নারী : ছোটোবেলায় না, কয়েকমাস আগে আমিও শুনছিলাম। এই পৌষেই আমাগো বটগাছতলায় আসর অইছিল।
রিকশাওয়ালা : তোর গলাডা সুন্দর। এমুন জব্বর বউ কয়টা মানুষের কপালে জোটে। যাই।
নারী : সাবধানে যাইও।
রিকশাওয়ালা : হ, তুই ঘরে যা, রিকশা চালামু আর তর কতা মনে অইতে থাকব। ঘরে আমার লক্ষ্মী বউ আছে। ফিরতে অইব তাড়াতাড়ি।
(রিকশাওয়ালা চলে যায়। তার স্ত্রী ঘরে প্রবেশ করে, দরজা লাগানোর শব্দ)
তিন.
(রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে)
রিকশাওয়ালা : বউ, ও বউ, চাইরডা ভাত দে।
নারী : এতো তাড়াতাড়ি আইয়া পরলা?
রিকশাওয়ালা : হ, আইজ বেশি চালাইতে ইচ্ছে করলো না। বিকালে সোয়ারিঘাট যামু।
নারী : ক্যান?
রিকশাওয়ালা : একটা বড়ো মাছ কিনা আনুম। গেরামে থাকতে বিলে চইলা যাইতাম বড়ো মাছ মারনের লাইগা।
নারী : তোমার মাছ ধরনের কতা জানি।
রিকশাওয়ালা : হাচাই জানস।
নারী : একবার নাকি মাইঝ রাইতে মাছ ধরতে গেছিলা বিলে। ভোর বেলায় ইয়া বড়ো এক বোয়াল ধইরা ফিরছিলা।
রিকশাওয়ালা : সবাই কয় অতো বড়ো বোয়াল মাছ আর কেউ ধরতে পারে নাই।
নারী : আর বিলে যে পথ হারাইছিলা।
রিকশাওয়ালা : খবরদার ঐ কতা কবি না। দেহ দেহি কেমুন হাসে। হাচাই কইতাছি। বড়শি লইয়া কোষা নাওয়ে বইসা আছি। আকাশে অর্ধেক চান। বড়শিতে কোনো মাছ আহে না।
নারী : কও কী?
রিকশাওয়ালা : মাঝ রাইতে চান্দের আলোয় দেহি আরেকটা নৌকা? তর তর কইরা আমারে পাশ কাটাইয়া যায়। সেই নাওয়ে কাঁচা মাছের গন্ধ। তুই বিশ্বাস করবি না। নাওয়ের গলুইতে ইয়া বড়ো রুই-কাতলা। দেখলেই মনডা ভালা অইয়া যায়।
নারী : হেরপর কী করলা?
রিকশাওয়ালা : আমি হেই নাওয়ের উল্টাদিকে বাইতে লাগলাম। কিছুদূর যাওনের পর বড়শি ফেলি, মাছ আহে না। চান্দের আলোয় দেহি জল তির তির কাঁপে। বিলের মইধ্যে একলা আমি আর আমার নাও।
নারী : ডর লাগে নাই তোমার?
রিকশাওয়ালা : ক্যান লাগবো না? দম বন্ধ কইরা নাওয়ে বইস্যা রইলাম। এমুন সময় কান্দনের শব্দ হুনি।
নারী : কও কী?
রিকশাওয়ালা : একটা মাইয়া কানতাছে। তার কান্দনের শব্দ য্যান আমার ঘাড়ের কাছ থেইক্যা আইতাছে। এইটা শোনোনের পর নাও ছাড়ি। দুই হাত বৈঠা চালাই। হাতে শক্তি নাই, তাও চালাই। আমার নাও য্যান নড়ে না। ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা অইয়া আহে য্যান। না, আবার দেহি আন্ধার। বিলে আমার নাও দিশা পায় না।
নারী : বড়োই ডরের কথা।
রিকশাওয়ালা : এমুন সময় দেহি আকাশ ফর্সা অইয়া আইতাছে। ভোরের আকাশে দূরে একটা গেরাম দেখতে পাই।
নারী : আলহামদুলিল্লাহ্।
রিকশাওয়ালা : নাও চালাইয়া হেই গেরামের ধারে যাই।
নারী : কপাল ভালো তোমার।
রিকশাওয়ালা : তা কইতে পারস। তা না অইলে কি আর তোরে ঘরে আনতে পারতাম?
নারী : হায়! হায়! খাওয়া শেষ তোমার।
রিকশাওয়ালা : হ, অহনই বাইরে যামু।
নারী : একটু গড়াইয়া গেলে অইতো না।
রিকশাওয়ালা : এহন বিছানায় গেলে ঘুম আইবো আমার।
নারী : তাইলে এইহানে বসো। তোমার লেইগা পান বানাইয়া আনি।
রিকশাওয়ালা : আমি রেললাইনের ধারে গেলাম। তুই পান বানাইয়া আন।
মিউজিক
চার.
(রিকশাওয়ালার স্ত্রী, ২৫ মার্চের কালরাতে ছুটে আসছে। থেমে থেমে গোলার শব্দ। দূরে কোথাও আর্তনাদ শোনা যায়। আগুন জ্বলছে। অনবরত গুলির শব্দ, দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ!)
নারী : হায় আল্লাহ্! কেয়ামত এতো তাড়াতাড়ি নামাইয়া আনলা।
লোক : কোথায় যাচ্ছিস?
নারী : তারে শেষ করে ফেলবে।
লোক : আরে ঐখানে গুলি হচ্ছে।
নারী : আমার স্বামী।
লোক : ঐ গুলির মধ্যে গেলে তো স্বামীকে আর পাবি না। ফিরা যা।
নারী : না না। আল্লাহ্ তারে ফিরাইয়া দেও।
লোক : ধুর যা, পালা।
(লোকটি ছুটে পালিয়ে যায়। এমন সময় দৌড়ে আসে বস্তির আরেকজন।)
নারী : মিয়াভাই, আমার স্বামী!
২য় লোক : আরে কি বেআক্কেইল্যা মাইয়া মানুষ। গুলি অইতাছে আর স্বামীরে খোঁজে। বাঁচলে কাইল দেহা অইবনে।
নারী : শোনেন শোনেন, সে তো আপনাগো পথেই গেছিল।
২য় লোক : জানি না। তার খবর জানি না। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।
(লোকটি ছুটে পালায়। নারী একা দাঁড়িয়ে থাকে। কারো গোঙানি শুনতে পায়। কয়েকটি জিপ চলে যায়। চারদিকে আর কোন শব্দ নেই।)
নারী : তারে কি একবারও দেখতে পামু না? আল্লাহ্!
এমন সময় গোঙানির শব্দ শোনা যায়। হামাগুড়ি দিয়ে একজন আসছে। সে সামনে এসে বলে-
রিকশাওয়ালা : ব্যারিকেড দিতে গেছিলাম।
নারী : এহনও বাঁইচ্যা আছেন, আলহামদুলিল্লাহ্।
রিকশাওয়ালা : হ।
নারী : তাইলে আল্লায় হুনছে।
রিকশাওয়ালা : আমার কতা হুন, এরপর আর কতা। আহ্!
নারী : আপনের পিঠে রক্ত?
রিকশাওয়ালা : হ, রক্ত। গাছের ডাল, ভাঙ্গা কাঠের টুকরা, টায়ারা, ইট- এইগুলান দিয়া ব্যারিকেড বানাই। আর মনের ভেতর ছিল একটাই চিন্তা, দেশটারে জালিমের হাতে দেওন যাইবো না।
নারী : এইডা কি অইলো!
রিকশাওয়ালা : কান্দিস পরে, আগে হোন। ব্যারিকেড বানাইয়া মনডা এত্তো বড়ো অইয়া গেল। হেরপর। হেরপর খালি জিপ গাড়ির আলো আর গুলি।
নারী : আপনে হেই গুলির সামনে খারাইলেন?
রিকশাওয়ালা : আমি অইলাম জয়বাংলার সৈনিক, গুলিরে কি আর ডরাই? বুক চিতায়া খাড়াইলাম। আহ্!
নারী : কষ্ট অইতাছে?
রিকশাওয়ালা : একদম না। হঠাৎ একটা গুলি আমার বুকে লাগলো! পারলাম না, মাটিতে শুইয়া পড়লাম। আমি বাঁচুম না। তয় একদিন এই জালিমরা দেশ ছাইড়া যাইবো।
নারী : আপনে চুপ করেন!
রিকশাওয়ালা : আমি মরে গেলে তুই আমার লাশ কবর দিবি। আর কেইবা আমায় কবর দিবো। আহ্!
(কয়েকজন ছুটতে ছুটতে আসে)
একজন : পালাও! পালাও!
দ্বিতীয়জন : রেললাইনের ধারে চলো।
নারী : হায় হের লাশ, অপেক্ষায় আছি একজন আসবো যে দাফন করবো।
মিউজিক
দেশের গান
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন