ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

সকলের সচেতনতায় ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব

তরিকুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৯, ১৪ জুন ২০২৪  
সকলের সচেতনতায় ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব

শহুরে মানুষের নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা ঈদের অন্যতম ঐতিহ্য। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে সবাই গ্রামে ফেরে। ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষ তুলনামূলক স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারলেও দুর্ঘটনা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। এবার পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে আজ থেকে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। ঈদে গ্রামে বাড়ি ফেরাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘনায় প্রাণ হারায় অনেকের স্বজন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, গত ঈদুল আজহায় যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৭৭টি দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত ও ৫৪৪ জন আহত হয়েছেন।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, দেশে বছরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। দেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির প্রায় ২.৫ শতাংশ, যা টাকায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমান। গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি-২০২৩ এ দেখা যায়, বিশ্বে ২০১০-২০২১ (১০ বছরে) রোডক্র্যাশে ৭১ হাজার সাইকেল চালকের মৃত্যু হয়। এই প্রতিরোধযোগ্য রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে দরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন।

সড়ক দুর্ঘটনার যত কারণ আছে তার মধ্যে অন্যতম বড় কারণ হলো গতি। দেখা যায়, যতগুলো সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় তার প্রায় সবগুলোর সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত বা অতিরিক্ত গতিতে মোটরযান চালানোর বিষয়টি সম্পর্কিত। বিশ্বের ৮০টির বেশি বড় বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যে কারণে জাতিসংঘসহ উন্নত দেশগুলো গতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। এজন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যাতে গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইনের দুর্বলতা হলো- আইনে গতিসীমা লঙ্ঘনের বিধান বর্ণিত থাকলেও গতিসীমা নির্ধারণ কিংবা পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা উল্লেখ করা হয়নি। মোটরযান আইনে যানবাহনের গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও চালকেরা মেনে চলেন না।

সড়ক দুর্ঘটনা সবার কাছে এক আতঙ্কের নাম। সড়কের মড়কে খালি হচ্ছে হাজারো মায়ের কোল। সরকারের একার পক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও, ছাত্রসমাজ, যাত্রী, চালক, পথচারীসহ সবাইকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ সরকারই নিতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার নতুন আইন করেছে। এ আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সর্বপ্রথম সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো খতিয়ে দেখা আবশ্যক। এসব দুর্ঘটনার কারণগুলো হচ্ছে- সচেতনতার অভাব, অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতা, দুর্নীতি, চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার, অপরিকল্পিত ও ভাঙ্গুর সড়ক, ওভারক্রসিং, অতিরিক্ত গতি, মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি, অনিয়ম, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালক এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানো। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম এ বিষয়ে সহায়ক ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে।

সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ এ সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ওই বিধিমালায় গাড়ির গতিসীমা, সিটবেল্ট, মানসম্মত হেলমেট, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশু আসন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয়নি। বেপরোয়া গতি, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা করা, সাইকেল-রিকশা-মোটরগাড়ি একই সঙ্গে চলাচল করার ফলে রোডক্র্যাশ নেমে আসছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও চালকরা তোয়াক্কা করছেন না। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিবছর ঈদ পূর্ব যাতায়াতকালে রোডক্র্যাশে মানুষ মারা যাচ্ছে।

ঈদুল আজহা উদযাপন উপলক্ষে সড়কপথে যাত্রীসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্নে ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে এবং আনন্দযাত্রায় রোডক্র্যাশে শত শত মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে যেসব পদক্ষেপ দ্রুত নেয়া দরকার তা হলো : অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে স্পিডগান ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, প্যাডেলচালিত রিকশা, অটোরিকশা, নছিমন-করিমন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

রোডক্র্যাশ এড়িয়ে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্নে করতে হলে মোটরসাইকেল চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সড়কে এখন সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেলের কারণে। তাছাড়া ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলে পুলিশ এবং সংশ্লিষ্টদের নজরদারি জোরদার করতে হবে। তবে শুধু চালকের বেপরোয়া গতিই রোডক্র্যাশের একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ ড্রাইভার, ভুয়া লাইসেন্স, অতিরিক্ত পণ্যসামগ্রী বা যাত্রী পরিবহণ, চালকের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতার অভাব, চলন্তবাস, ট্রাকে, মুঠোফোন ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে রোডক্র্যাশ ঘটে। আবার অনেক সময় দেখা যায় খারাপ রাস্তায়ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও ওভারটেক করার হীনমানসিকতাও এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

মূলত নাড়ির টানে ঘরে ফেরা মানুষের আসল যুদ্ধ শুরু হয় পবিত্র ঈদ আসলেই। প্রতিবছরই ঈদে নগরবাসী মানুষের বাড়ি ফেরার সময় পড়তে হয় নানা রকম ভোগান্তিতে। অনেকের তো বাড়িই ফেরা হয় না। রোডক্র্যাশ, অতিরিক্ত যানজটসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতেই থাকে। পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের জন্য নিয়মিত রাস্তাঘাট মেরামতসহ গতিবিধি মেনে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করতে পারলে অনেকাংশেই রোডক্র্যাশ রোধ করা যাবে। গতিবিধি না মেনে গাড়ি চালালে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে।

আপনজন হারানোর বেদনা শুধু স্বজনরাই অনুভব করছেন বারবার। কে, কখন, কোথায়, কীভাবে রোডক্র্যাশের সম্মুখীন হবেন তা কেউ জানে না। বাস্তবিক অর্থেই এটা এখন মহামারির রূপ নিয়েছে। এর রাশ টেনে ধরতেই হবে, থামাতে হবে শবযাত্রার মিছিল। তবেই হয়তো উৎসবে নাড়ির টানে যাত্রা আর ফিরতিকালে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়বে না কেউ, বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার সময় লাশ হয়ে ফিরবে না! রোডক্র্যাশে এই মৃত্যুর মিছিল সামাল দিতে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা জনগণ ভীষণভাবে অনুভব করছে। রোডক্র্যাশ নিয়ন্ত্রণে আসুক, প্রতিটি উৎসব হোক নিরাপদ, উৎকণ্ঠাহীন, বর্ণিল ও আনন্দময়।

লেখক: অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেইফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়