ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

পঞ্চম পর্ব

লোলেগাঁও ও গ্যাংটক ভ্রমণের দিনরাত্রি 

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৭, ১৫ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৭:০২, ১৫ জুন ২০২৪
লোলেগাঁও ও গ্যাংটক ভ্রমণের দিনরাত্রি 

সাঙ্গু লেকের পাড়ে চমরী গাইয়ের পিঠে তোলা ছবি

আধুনিক সিকিম বহুজাতি ও বহুভাষীর দেশ। দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি, নেপালি, সিকিমীয় ও লেপছা। রাজ্যের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণার্থে অন্যান্য ভাষা গুরুং, লিম্বু, মগর, মুখিয়া, রাজ, শেরপা ও তামাং ইত্যাদিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্কুলে ইংরেজিতে পড়ানো হয়। সরকারি দপ্তরেও ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। হিন্দুধর্মের আধিপত্য বেশি, তবে স্বল্পসংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতিও সুবিচার করা হয়।

সিকিমের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে পর্যটন ও কৃষিনির্ভর। সিকিমে কৃষিতে সার প্রয়োগ করা হয় না। ভারতে সিকিম এই ক্ষেত্রে এক নাম্বার। পরিবেশ রক্ষায়ও সিকিম শীর্ষে। এখানে রাষ্ট্রীয় কাজে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় না। গোটা রাজ্যে প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ।

তিব্বতবিদ্যা ও তিব্বত সংস্কৃতির কেন্দ্র গ্যাংটক শহর হিমালয়ের সমীহ জাগানো পর্বতশৃঙ্গসমূহের কোলে অবস্থিত। এটি ভারতের সিকিম রাজ্যের রাজধানী এবং বিশ্ব পর্যটকদের প্রিয় ভ্রমণস্থল। এখান থেকে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। এনচে মঠ নির্মিত হওয়ার পর থেকে এই নগরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যদিও মঠটি ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে সেখানে বহু মঠ ও শিক্ষালয় গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া এখান থেকে সোমগো বা সাঙ্গু হ্রদ, যামথাং উপত্যকা, নাথুলা পাস, পেলিং, রুমটেক মঠ দর্শনে যাওয়া সহজ।

পাহাড় কেটে কেটে সিকিম যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। আমাদের ডানে পাহাড়, বাঁয়ে গভীর খাঁদ। তাকাতেই বুক খালি বোধ করি। শরীরে ভয়ের শিহরণ জাগে! খাঁদে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী তিস্তা। ওপারে ‘শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।’ কোথাও ঘনশ্যাম, কোথাও ফিকে শ্যাম।

          করোনেশন ব্রিজ

আমাদের চলার পথে ডানে পর্বত, বাঁয়ে তিস্তা নদী। তিস্তা ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী। হিমালয়ের পূর্বাংশে পউহুনরি পর্বত এর উৎসস্থল। এটি সিকিমের ম্যানগান, গ্যাংটক, প্যাকিয়ং, পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা এবং রংপো, জলপাইগুড়ি ও মেকলিগঞ্জ শহর হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় প্রবেশ করেছে। এর পর তিস্তা রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফুলছড়ি উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। নদীর ৩০৫ কিলোমিটার ভারতে এবং বাংলাদেশে ১০৯ কিলোমিটার অঞ্চলে বিস্তৃত। 

তিস্তা সিকিমের সবচেয়ে বড় নদী এবং পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। চলার পথে নদীর কলতান মাঝে মাঝে শোনা যায়। কারণ এর বেশির ভাগ অংশ গভীর খাঁদে বয়ে চলেছে। কখনোসখনো ভালোভাবে দেখা গেলে এর পাগলপাড়া খরস্রোত উপভোগ করা যায়। সবচেয়ে নয়ন সুখকর দৃশ্য হলো তিস্তা নদীতে কিছুক্ষণ পরপর নেমে আসা ছোট-বড় ঝরনা। দূরে থাকাতে আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল ‘তরলিত চন্দ্রিকা চন্দনবর্ণা ঝর্ণা’ নয়, যেন প্রকৃতি মায়ের ফেনিল দুধের ফোয়ারা।  

জীপের ড্রাইভার জানালেন আমরা দুই তৃতীয়াংশ পথ পেরিয়ে এসেছি। দুপুর ২টার মধ্যে পৌঁছে যাবো। এর প্রায় মিনিট দশেক পর দেখি গাড়ি থেমে গেলো। নেতারা নেমে দেখলো।  আমাদের সামনে প্রায় ৩৫-৪০ টি জীপ, বাস দাঁড়িয়ে আছে। জানা গেলো পাহাড় থেকে মাটি ও শিলার ধস নেমেছে। তিন চারটা গাড়ি খাদে বা মাটির স্তূপের নিচে চাপা পড়েছে। আমরা রংপো ও প্যাকিয়ং জেলার মাঝামাঝি অবস্থানে আছি।

পাহাড়ি পথে হরহামেশাই ছোট-বড় ধস নামে। বর্ষাকালে বেশি। এর জন্য আধুনিক সাজসরঞ্জাম নিয়ে উদ্ধারকর্মীরা সবসময় প্রস্তুত থাকেন। এদিকে যেমন গাড়ি আটকে আছে, তেমনি ধসের ওপারেও অনেকে আটকে আছেন। আমরা গাড়ি থেকে নামি। যদুনাথ বাবু আগে থেকে বলছিলেন, ‘চোখ রাখবেন তো চায়ের দোকান রয়েছে কি না।’ সরসী বললেন, ‘ফ্লাস্কে তো চা রয়েছে।’ যদুনাথ বাবু তাতে হবে না। তিনি বললেন, ‘ওটা চা নেই, দই হয়ে গেছে। ফ্রেশ গরম জল এর চেয়ে ভালো।’ আমি বলি, ‘‘যদুনাথ বাবু, বনফুলের ‘কিছুক্ষণ’ সিনেমার কথা মনে পড়ে?’’
‘বিলক্ষণ।’
‘এই পথে তা পাবেন না। অবশ্য ২/১ দিন থাকতে হলে কোনো বাঙালি সন্তান উদ্যোগ নিতেও পারেন।’

সাঙ্গু লেক

লিডারেরা আশার বাণী শোনালো। সেনারা বিকল্প রাস্তা বানাচ্ছেন। তা দিয়ে একটি একটি করে গাড়ি পাড় করাবেন। অর্থাৎ এদিক থেকে একটি এবং ওদিক থেকে একটি চান্স পাবে। আমাদের চান্স এলো দেড় ঘণ্টা পরে। কূর্মগতিতে সিকি কিলোমিটার পথ পেরোতে আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগলো। এরপরও জোরে চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, সামনে পরপর গাড়ি। ওভারটেক করা সম্ভব নয়। যা হোক, শেষাবধি পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিমে ঢোকার করোনেশন ব্রিজে পৌঁছাই। ব্রিজ বা সেতু পেরিয়ে চেকপোস্ট। তিস্তা নদীর উপরে ১৯৩৭ সালে নির্মিত এই সেতু খুবই সুদৃশ্য। সেসময় সিকিমে ঢোকার জন্য ভারতীয়দের রেশন কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিদেশীদের ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট দেখানো বাধ্যতামূলক ছিল। রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানির স্মৃতি রক্ষার জন্য সেতু নির্মিত হয়। এই সেতুর অন্য নাম সেভোক। সেভোক শহরের ওপরে অবস্থিত বলে এ নাম। সেতুটি জলপাইগুড়ি, কালিমপং ও দার্জিলিঙের সঙ্গে যোগসূত্র।

চেকিং সারতে ১৫মিনিট লাগলো। আমরা এখন সিকিমে। আধ ঘণ্টার মধ্যে গ্যাংটক পৌঁছে গেলাম। তখন অপরাহ্ন প্রায় ৪টা। যেখানে আমাদের নামিয়ে দিল, সেখান থেকে নির্দিষ্ট হোটেলে যেতে প্রায় ১৫ মিটার পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। সঙ্গে থাকা বিস্কুট, পাউরুটি, মধু, জেলি মাঝে মাঝে খেয়েছি। করোনেশন ব্রিজ পার হওয়ার আগে থেকে পেটে খিদে। সকলে ক্ষুধার্ত। মালবহর টেনে হোটেলের তিন তলায় আমাদের পক্ষে তো অসম্ভব, ছেলেদের জন্যও কষ্টকর। 

এমন সময় সুবল গুরুং হাজির। সুঠাম দেহের ছেলেটি লম্বায় প্রায় ৭ফুট। সে মাল নিয়ে যাবে। সব মাল হোটেলের তিন তলায় পৌঁছানোর জন্য সে ১৫০ রুপি দাবি করল। লিডারেরা ১০০ রুপিতে রাজি করালো। আমরা নিচে থাকবো। ছেলেরা সুবলের সঙ্গে সঙ্গে যাবে। শেষবার আমরা উঠবো। সুবল মাথায় কাঁধে, হাতে একটার পর একটা ব্যাগ ওঠাতেই থাকে। সব ব্যাগ এমনকি মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগটিও নিয়ে সে তরতরিয়ে ছেলেদের আগে পাহাড় বেয়ে উঠে যায়। আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! সুবলের শক্তি দেখে বিস্ময়বোধ করি। সম্ভবত এদেরকেই বলে পাহাড়ি বিচ্ছু। 

আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পাহাড়ে না উঠতেই ওরা হোটেলের তিন তলায় চলে যায়। সুবল বাংলা মোটামুটি বুঝে। লিডারদের বললাম ওকে ১০ টাকা বকশিশ দিতে। সুবল মাথা নেড়ে আপত্তি জানায়। তার বক্তব্য ১০০ টাকাই যথেষ্ট। আমরা তাকে সময় পেলে আসার আমন্ত্রণ জানাই।

লিডার হোটেল ম্যানেজারকে রুমে খাবার পাঠানোর অনুরোধ করেছিল। ম্যানেজার বাঙালি। এক বঙ্গ ধনকুবেরের হোটেল। স্নান সেরে খেয়ে পিঠটান দেই। ছেলে বউ খেয়েই বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যায় চার বয়স্ক হোটেল থেকে নেমে পাহাড়ের নিচে এক চায়ের দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই। এখানকার চায়ের স্বাদ অপূর্ব। পাহাড়ি গরু বা মোষের ঘন দুধ চায়ের মান অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা সোজা রাস্তায় হাঁটতে থাকি। বাঁয়ে পাহাড়, ডানে নানা পসরা সাজানো দোকান। পসরার মধ্যে পাহাড়িদের কুটিরশিল্পই বেশি। দাম মেটামুটি। মলিনা ও সরসী কিছু টুকটাক কিনল। কিছুদূর পরপর ছোট কাচের ঘেরাটোপে এক বা দুইজন পুলিশ বসা। কাচে লেখা ট্যুরিস্ট পুলিশ। নিচে লেখা এনি প্রবলেম, মে উই হেল্প ইউ। বুঝলাম এরা পর্যটন শিল্পকে কি পরিমাণ গুরুত্ব দেন। আমরা আর একবার চা-নাস্তা খেয়ে হোটেলে ফিরি। নেতারা কোথায় আমরা জানি না। রাত নয়টার পর তারা আসে। ওরা সকালে হেভী নাস্তা করে, স্নান সেরে সকাল দশটায় রেডি থাকার সমন জারি করে।  ফার্স্ট এইড বক্সে বমির ওষুধ বেশি পরিমাণ আছে কি না তাও দেখে নিতে বলে।

হোটেল বয় খাবার দিয়ে যায়। আমরা নয় জন এক সঙ্গে আহার সারি। মুরগির ঝোল, ডাল আর কুমরো ভাজি। গাড়িতে বমি পায় সরসী, মিলি ও মাঝে মাঝে যদু বাবুর। ওরা রাস্তার যে ছবি দেখালো তা দেখে এমনিতে বুকে ধুকপুক শুরু হওয়ার কথা।

      
         নাথু লা পাস থেকে গ্যাংটকের সড়ক। ট্রাক নামছে

নাথু লা পাসে যেতে হলে ড্রাইভারকে মিলিটারির সম্মতি নিতে হয়। সাঙ্গু হ্রদের আগে মিলিটারি চেকপোস্ট। সম্মতিপত্র দেখে গাড়ি চেক করে যাওয়ার অনুমতি দেন। ভাড়া মোটামুটি ফিক্সট। পরদিন আমরা নাথু লা পাস, সাঙ্গু লেকের উদ্দেশ্যে রওনা করি। রওনার ঠিক আগে সুবল গুরুং হাজির। সে হোটেল থেকে আমাদের পথের খাবারদাবার ও সামান্য গরম কাপড়ের ব্যাগ নামিয়ে জীপে রেখে আসে। লিডার ওকে চা-টিফিনের জন্য ১০ টাকা দিলে সে খুশি হয়ে চলে যায়।

গাড়ি যতোই উপরের দিকে উঠতে থাকে ততোই বুকে ধড়কান শুরু হচ্ছে। বাঁয়ে পাহাড় এবং কিছুদূর পরপর ছোট-বড় ঝরনার জল পথে এসে পড়ছে। কিন্তু ডানদিকে? গভীর খাদ।  ড্রাইভার দুর্বল চিত্তের লোকদের ডানে না তাকানোর পরামর্শ দেন। বিশ্বকবি সম্ভবত এরকম পরিস্থিতিতে ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন...’ লিখে মনের ভয় কাটাতে চেয়েছিলেন। 

আরো উপরে উঠলে ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত শীত অনুভূতি হলো। সাথে হালকা সোয়েটার ছিল। ডান দিকে গভীর খাদ হলেও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য চোখকে সম্মোহিত করে। খাদে গরু বিচরণ করছে বোঝা যায়। কিন্তু মনে হয় বিন্দু নড়াচড়া করছে। যেখানে ঝরনার জল প্রবলভাবে রাস্তা পেরিয়ে খাদে নামছে সেখানে নেমে ঝরনার জলে হাত-মুখ ধুয়ে নেই। জল কিন্তু বেশ ঠান্ডা। (চলবে)  

পড়ুন চতুর্থ পর্ব : লোলেগাঁও ও গ্যাংটক ভ্রমণের দিনরাত্রি 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়