ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

‘জামায়াত ওদের মতো করে সমাজ অনেকটা রূপান্তরিত করতে পেরেছে’

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:১৪, ৩ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ২২:১৮, ৩ আগস্ট ২০২৪
‘জামায়াত ওদের মতো করে সমাজ অনেকটা রূপান্তরিত করতে পেরেছে’

আবুল মোমেন, কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন। কথোপকথনে ছিলেন স্বরলিপি

রাইজিংবিডি: একটি ছাত্র আন্দোলন যেভাবে ছড়িয়ে পড়লো— এটা কেন হয়েছে বলে মনে হয়?

আবুল মোমেন: নানা কারণে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে একটা ক্ষোভ আছে, হতাশা আছে। ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে বেকারের সংখ্যা সরকারি হিসেবে আট লাখ। প্রতি বছর নতুন করে অনেক বেশি বেকার যোগ হয়।  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের যে দখলদারি দীর্ঘদিন ধরে— সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ আছে। ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ অনেক কাজ করেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সময়ে দুর্নীতি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রত্যেক এলাকাভিত্তিক আওয়ামী লীগের নামধারী লোক মানুষের ওপর তাদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে থাকে। সব কিছু মিলিয়ে মানুষের মধ্যে একটা বিষ্ফোরণ হয়েছে। 

রাইজিংবিডি: চলমান আন্দোলনের মধ্যে এই যে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলো— বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

আবুল মোমেন: এটা তো সরকারের আরও আগেই করার ছিল। কিন্তু আমার বিবেচনায় সরকার তাদের রাজনৈতিকভাবে অনেক সময় ব্যবহার করেছে। এটা হচ্ছে ক্ষমতার কৌশলের রাজনীতি। আবার এটাও হয়তো তারা ভাবে, তারা যদি সরকারের একেবারে বিরুদ্ধ অবস্থানে থাকে তাহলে তারা বিএনপির সঙ্গে আরও বেশি একত্রিত হবে। এটা থেকেও হয়তো দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছে। কিন্তু এটা করলেই জামায়াতের রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে না। যেহেতু সমাজে এরা একটা চাহিদা তৈরি করেছে। তাহলে এই রাজনীতি তো সমাজে থাকবে। এরা হয়তো সামনে সংগঠন হিসেবে গোপনে থাকবে। আগেও আমরা দেখেছি। যখন নিষিদ্ধ ছিল তখন ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ হিসেবে রাজনীতি করেছে। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে দুইমত, তিনমত ছিল। অনেকেই বলেছিল ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামটা ব্যবহার না করা ভালো হবে। যেহেতু তাদের এই নামে অনেকে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে রয়েছে। 

রাইজিংবিডি: এখন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি যেভাবে মূলধারার রাজনীতিতে মিলেছিল একই রকমভাবে ফিরবে কিনা?

আবুল মোমেন: হতেই পারে। এখন তারা হয়তো বিএনপির মধ্যে ঢুকে যাবে। এর আগে দেখেছি আওয়ামী লীগও তাদের নিয়েছে। ফলে ওদের খুব যে অসুবিধা হবে আমার তা মনে হয় না। কারণ সমাজে তারা একটা জায়গা করে নিতে পেরেছে। 

রাইজিংবিডি: জামায়াতের যে আদর্শ তার প্রতিফলন এই মুহূর্তে কোনো দলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে কি না? 

আবুল মোমেন: না। জামায়াতের যে ‘কোর’ আদর্শ সেটা এই দলগুলোর মধ্যে প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু তাদের তো নিজেদের একটা শক্তি বজায় রাখা, সমাজে শক্তি বজায় রাখার জন্য বড় দলগুলোর সহযোগিতা নেওয়া এটা তারা কৌশল হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু একেবারেই যদি আপনি তাদের ‘হার্ড কোর’ আদর্শের কথা ভাবেন তাহলে তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তারা নারী নেতৃত্বে বিশ্বাস করে না; ফলে তারা স্বরূপ-স্বমূর্তিতে প্রকাশ পেলে কেমন হবে এটা আমরা এখনও জানি না। তারা তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে।

১৯৮৯ তে যখন ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়েছে তখন প্রথম থেকে শাহ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সেখানকার কমিউনিস্টরা। সেই নেতারাই পরে ফাঁসিতে ঝুলেছে। কারণ আন্দোলনটা খোমিনির জনপ্রিয়তার কারণে তার হাতে চলে গেছে। ইরানি নাগরিক সমাজের মধ্যে একটা আধুনিক চিন্তা-ভাবনা ছিল। কিন্তু বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজে কট্টরপন্থার একটা বিরাট জায়গা ছিল। ফলে তাদের পক্ষে এরা রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নিতে পেরেছিল। আমাদের দেশে জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে আছে কিন্তু তারা সমাজে অনেকদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। আমি বলি যে, সমাজটা জামায়াত ওদের মতো করে অনেকটা রূপান্তরিত করতে পেরেছে। এর পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর সহযোগিতা করেছে কিন্তু তারা সেটা পেরেছে। ফলে তাদের রাজনৈতিক চাহিদাও আমার মনে হয় যে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে আছে। 

ওদের ভূমিকাকে সংকুচিত করতে চাইলে তাহলে যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি যেটা সেকুলার ভাবাদর্শের রাজনীতি সেটাকে অনেক বেশি সক্ষম হয়ে উঠতে হবে। সৎ হতে হবে এবং জনগণের মধ্যে স্থান করে নিতে হবে। সরকার একটু বিচলিত হয়েছে। কিন্তু ওরা এখনও পর্যন্ত ভাবছে যে সামলে উঠতে পারবে। কারণ হলো সাধারণত ক্ষমতার একটা গোষ্ঠী  থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো ভাবে আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী এবং ধনিক গোষ্ঠী; এই তিনটা পক্ষ যদি পক্ষে থাকে তাহলে টিকে যাওয়ার কথা। সেটা আওয়ামী লীগ ধরে রাখতে পেরেছে। আমাদের দেশে একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে সামরিক বাহিনী সরকারকে চাচ্ছে নাকি চাচ্ছে না। যেমন এরশাদের পতন হলো, তখন সামরিক বাহিনী তাকে আর সাপোর্ট দিতে রাজি হয়নি। এখানে অন্যান্য শক্তি যেগুলো আছে তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে যে— তারা কি চায়। পর্দার আড়াল থেকে এই ঘটনাগুলো ঘটে।

রাইজিংবিডি: চলমান অবস্থা রাজনৈতিভাবে মোকাবিলার সুযোগ আছে কিনা?

আবুল মোমেন: আওয়ামী লীগ সেটা হারিয়ে ফেলেছে। দেখেন, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে কথা বলছে তার দলের নেতাকর্মীরা মানছে না। 

রাইজিংবিডি: সরকার এখন তাহলে কোন রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারে?

আবুল মোমেন: একটা কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। কারণ সরকার ‘রি অর্গানাইজড’ হতে চাচ্ছে। ছাত্র-জনতার গণমিছিল সরকার অর্গানাইজ করেছে। ওরা চাচ্ছে রাজপথে ওদের জায়গা বাড়াতে। ছাত্ররা রাজপথ দখল করে ফেলেছে তো—এখন আওয়ামী লীগ চায় ‘ছাত্র-জনতার মিছিল’ এরকম নানা নামে রাজপথে থাকার চেষ্টা করবে। রাজপথের দখল নেওয়ার চেষ্টা করবে। ওদেরকে কম জায়গা দিয়ে নিজেরা বেশি জায়গা দখলের চেষ্টা করবে। এমনটা হতে পারে। 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়