ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

সরকারের পতন এবং হেরে যাওয়া এক মৃতের উপলব্ধি 

জাহাঙ্গীর আলম বকুল  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১০, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২০:০৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সরকারের পতন এবং হেরে যাওয়া এক মৃতের উপলব্ধি 

আমি লাশ হয়ে শুয়ে আছি অচেনা, অজানা এক থানার বারান্দায়। আপাদমস্তক পলিথিনে মোড়ানো আমার নিথর দেহটা কয়েকজন ধরাধরি করে এখানে মেঝেতে ফেলে রেখে গেছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেঝেটা শক্ত এবং বেশ ঠান্ডা। এমন মেঝেতে বহুকাল শুইনি। ছাত্ররাজনীতি করার সময় যখন মাঝে-মধ্যে পালিয়ে থাকতে হতো, তখন কোনো মেসে বা হলে-হোটেলের মেঝেতে শুয়ে থাকতাম। দু’-একবার পুলিশের হাতে আটক হয়ে থানায় মেঝেতে শুয়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু, তখন চোখে স্বপ্ন ছিল, মনে আশা ছিল। দেশ-জাতির জন্য বড় কিছু করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। তাই, ছোটখাট এমন সমস্যা গায়ে মাখিনি। তখন দু’-এক দিনের মধ্যে থানা থেকে বড় ভাইরা এসে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে অথবা পুলিশ আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছে। আদালত থেকে কয়েক দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছি। এভাবে কখনও অচেনা-অজানা পরিবেশে সঙ্গীহীন থাকতে হয়নি। আজ যেখানে শুয়ে আছি, আমি জানিও না, এটা কোথায়? তবে, এটা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি এলাকার কোনো থানা, এটা নিশ্চিত।

সিলেট সীমান্ত অতিক্রম করে চোরাপথে একসঙ্গে তিনজন মেঘালয় রাজ্যে ঢুকেছিলাম। সীমান্তের দু’পাশই আমার জন্য বিপদসঙ্কুল ছিল। আমার দেশের অংশে পুলিশ-বিজিবির চেয়ে বেশি ভয় ছিল জনতার। জনগণের হাতে ধরা পড়লে তো নিস্তার ছিল না। নির্ঘাত গণপিটুনি। ভয়ে বুকটা দুরু দুরু কাঁপছিল। তারপর আমার সঙ্গে দুটি ব্যাগ ছিল। এই বোঝা নিয়ে পরিচয় গোপন করে মাইলের পর মাইল হেঁটে, কখনও বাস, রিকশা বা ভ্যানে করে গভীর রাতে সীমান্তে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানে কয়েক দিন নিরাপদে ছিলাম। তখনও মনে একটু আশা ছিল, সব জায়গায় তো আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীরাই বসে আছে। তারা এই ১০-১৫ জন উপদেষ্টার দুর্বল সরকারকে ঠিকই অসহযোগিতা করবে। পাল্টা অভ্যুত্থান হয়ত ঘটাবে। চেষ্টাও সম্ভবত হয়েছিল, কিন্তু ফল হয়নি।

সব আশা শেষ হয়ে যাওয়ার পর অগত্যা দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া পথ ছিল না। সেই আত্মীয় সীমান্ত পার করার জন্য লোক ঠিক করে দেন। সেই পথপ্রদর্শকের ডিমান্ড ছিল মোটা অঙ্কের টাকা। তাতেই রাজি হতে হয়। একদিন শেষ রাতের দিকে তার সঙ্গে পা বাড়ালাম। পথপ্রদর্শক ভদ্রলোকটি আমাকে এনে পাহাড়ের নিচে জঙ্গলের মধ্যে বসিয়ে রাখল। বুঝলাম, তিনি কারও অপেক্ষায় আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আরেক পথপ্রদর্শক আরও দুজনকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো। তারাও একই কারণে একই পথের যাত্রী। সেই আবছা অন্ধকারের মধ্যে সেই দু’জনকে চিনতে আমার এতটুকু সমস্যা হয়নি। তাদের কণ্ঠ, চলার ধরন আগে থেকে পরিচিত। তাদের পেয়ে আমি মনে সাহস পেলাম। আমি পাগলের মতো লাফিয়ে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তাদের একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার নাম ধরে শুধু বললেন, সাজানো-গোছানো সবকিছু হঠাৎ শেষ হয়ে গেল! তারপর আমরা নীরবে শুধু পথপ্রদর্শকদের অনুসরণ করে পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে পথ চলতে থাকি। কেউ কোনো কথা বলিনি। আমরা যেন সবাই জানি, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কোথায় এবং কেন?

বন্ধুর এবং বিপদসঙ্কুল পথে চলতে বেগ পেতে হচ্ছিল। পথপ্রদর্শকরা এ পথ চলতে অভ্যস্ত। তাদের জন্য সহজ ছিল। তারা আমাদের দুরবস্থা দেখে মাঝে-মধ্যে বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছিল। একসময় অন্ধকার তাড়িয়ে পূর্বের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করে। আমাদেরও পথচলা কিছুটা সহজ হয়। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত আমরা পাহাড়ের মধ্যে কিছুটা সমতল জায়গায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় পা আর চলতে চায় না। একটি ব্যাগ মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। অন্য ব্যাগটিও শক্ত করে আকড়ে ধরে রেখেছিলাম। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছিল। তারপরও জোর করে চোখ খোলা রাখছিলাম। তখন পথপ্রদর্শকরা জানাল, আমরা ইতোমধ্যে ভারতে ঢুকে পড়েছি। এ কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হলো, আমি এখন নিরাপদ। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটি হোটেলে পৌঁছে যাবো।

মনে একটু স্বস্তি ও পুলক অনুভব করলাম। যা হোক, দেশের জেল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে পরিত্রাণ মিলল। এ দেশে নিরাপদে থেকে সময়-সুযোগমতো আবার নিজ দেশে ফিরে যাওয়া যাবে। এখানে থেকে এলাকার খবরাখবর রাখা যাবে।

বিপদ কেটে গেছে জেনে শরীরটাও যেন ছেড়ে দিলো। ক্ষুধাটাও বেড়ে গেল। আমরা ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিতে চাইলে পথপ্রদর্শকরা সম্মতি দিলো। তারা দু’জন পাশের ঝিরি থেকে পাানি আনতে গেল। তখন শুধু আমরা তিনজন। সবাই সবার দিকে তাকিয়ে আছি। কথা বলতে পারছি না। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সবাই সবার অব্যক্ত কথা জানি। সবাই যেন কত অপরাধী। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছি।

আসার সময় পথে খাওয়ার জন্য সেই আত্মীয়ের স্ত্রী কিছু শুকনো খাবার দিয়েছিল। সেটার কথা হঠাৎ মনে পড়ল। হাতে আঁকড়ে ধরা ব্যাগের মধ্যে আছে। ব্যাগের চেইনের তালা খুলে খাবার বের করার চেষ্টা করছিলাম। সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখছিলাম, যেন ব্যাগের ভেতরটা দেখা না যায়। কিন্তু, কেমন করে যেন নোটের বান্ডিলগুলো বাকি দু’জনের চোখে পড়ে গেল। আর তাতেই ঘটে গেল বিপত্তি।

থানার বারান্দায় শুয়ে শুয়ে কত এলোমেলো চিন্তা মাথায় আসছে। অনন্তকালের এই নিদ্রায় চিন্তামুক্ত-শঙ্কামুক্ত থাকতে চাই, কিন্তু কেন যেন পারছি না। কিছুতেই বিক্ষিপ্ত দুশ্চিন্তাগুলো তাড়াতে পারছি না। বেঁচে থাকতে সারা দিন এত প্রোগ্রাম, মিটিং, ফোন কল, স্বাক্ষর করা—এসব নিয়ে এত ব্যস্ততা; শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারতাম না। ঘুমের ওষুধের ডোজ শুধু বেড়েছে, কাজের কাজ তেমন হয়নি। এখন শান্তিতে ঘুমাতে চাই। ইতোমধ্যে কয়েকজন পুলিশ থানায় এসেছে। তারা আমার বিষয় নিয়ে বলাবলি করছে। কীভাবে আমার মৃত্যু হয়েছে, জানতে চায় তারা। এজন্য মরদেহের ময়নাতদন্ত করবে। লাশ মর্গে পাঠিয়ে দেবে। মর্গের ঠান্ডা ঘরে কতক্ষণ থাকতে হবে জানি না। আমি সেখানে যেতে চাই না, কিন্তু মতামত জানানোর অবস্থা নেই। আজ মৃত্যু আমাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে।

আমি নিশ্চিত জানি, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে কীভাবে আমার মৃত্যু হয়েছে, তা বেরিয়ে আসবে। তারপর দেশে হয়ত এটা নিয়ে আলোচনা হবে। ধীরে ধীরে সবকিছু একদিন সবাই ভুলে যাবে। মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে সব হারিয়ে যাবে। আমি যে একটা সময়ের জন্য এই ব্রহ্মাণ্ডে এসেছিলাম, ক্ষমতার কাছাকাছি ছিলাম, উদায়স্ত মানুষের জন্য করেছি, কিছু বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছিলাম, সবই হারিয়ে যাবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে, তারা আমার নামও জানবে না।

আজ আমি বড় একা। হিমশীতল ঘরে শুধু একা। একদিন আমার চারপাশে কত মানুষ ছিল। তারা কারণে-অকারণে আমার পাশে ভিড় করত। কতদিন চেয়েছি, একা একা কিছু সময় থাকতে, পারিনি। কতবার ভেবেছি, কিছু দিনের জন্য দূরে নিরিবিলি কোথায় গিয়ে সময় কাটাব, হয়নি। আজ আমার অফুরান্ত সময়। অনন্তকাল আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তবু একটু শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারছি না। এটা এখন স্পষ্টত বুঝতে পারছি; অতীতের সব হিসাব এখন আমাকে একাই চুকাতে হবে। আজ আমার পাশে কেউ নেই।

যাদের সঙ্গে আমার এতদিনের চেনাজানা, এত বিশ্বাস; তারাই নিমিষে আমাকে নিঃস্ব বানিয়ে দিল। আমার অর্থ-সম্পদ লুট হয়ে গেল। যাদের জন্য আমি সারাজীবন এত করলাম, তারা আমার সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসল না। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর হাতে কাছে যে ডলারগুলো ছিল, তা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কতটা ছিল জানতাম না, তবে ধারণা ছিল প্রবাসে বাকি জীবনটা আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত। সেই ডলারের জন্য আমাকে জীবন দিতে হলো। আমার দুজন সহযাত্রী, আমার দীর্ঘদিনের সুহৃদ, আমাকে কৌশলে পাহাড় থেকে ফেলে দিলো। হায় বিশ্বাস! কাদের সঙ্গে জীবনের দীর্ঘ সময় একসঙ্গে পথ চললাম?

পাহাড় থেকে পড়ে মৃত্যুর সময় কেউ আমার কাছে ছিল না। পাহাড়ের খাদের মধ্যে মৃত্যুর সময় কারও অশ্রুসিক্ত নয়ন আমি দেখিনি। আজ আমি দুই কালের মাঝে দাঁড়িয়ে স্পষ্টত বুঝতে পারছি, দুনিয়ায় আমি অনেক আগেই একা হয়ে গিয়েছিলাম। প্রবাসে আমার একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর পর নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে আরও ব্যস্ত থাকতে শুরু করি। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতাম। মন একটু ফুরসত খুঁজত। সব ব্যস্ততা ফেলে দূরে কোথায় হারিয়ে যেতে মন চাইত, কিন্তু একটা অজানা আতঙ্ক ভর করত। নিজেকে মুক্তি দিতে পারিনি। যে অনন্ত-অসীম শক্তির কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে শান্তি পেতে পারতাম; বেঁচে থাকতে তার খোঁজ করিনি।

আমাকে কিছুক্ষণ পর দাফন করা হবে। বিদেশে-বিভুঁইয়ে। আমার কবরের পাশে কেউ কখনও আসবে না। একটা সময় আমার কবরও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সারাজীবনে এত এত অর্জনের পর এই মৃত্যু আমি চাইনি। আমি চাইনি বলে এড়াতেও পারিনি। আমি হেরে গেলাম। আসলে অনেক আগেই হেরে গিয়েছিলাম; কিন্তু আমি, আমরা সেটা বুঝতে পারিনি; অথবা বুঝতে চায়নি। 
(কাল্পনিক)।

   
   
     
      

        

       

 

ঢাকা/রফিক    


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়