এক দলীয়করণ থেকে আরেক দলীয়করণ চাই না: জিএম কাদের
নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ দাবি করে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, দুটি দলই দলীয়করণের মাধ্যমে সকল প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত করেছিল। আমরা কখনও প্রশাসন ও বিচারবিভাগ দলীয়করণ মুক্ত পেয়েছি? এক দলীয়করণ থেকে আরেক দলীয়করণ চাই না।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানীস্থ কার্যালয় মিলনায়তনে জাতীয় যুব সংহতির নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির তিনি এসব কথা বলেন।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে ভালো নির্বাচন হলেও দেশ ভালো সরকার পায়নি। সুষ্ঠু নির্বাচনের পর আমরা কখনো সঠিক রাজনীতি পাইনি। আমাদের সংবিধান এক ব্যক্তির হাতে সকল ক্ষমতা দিয়েছে। একই ব্যক্তি নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও প্রায় শতভাগ বিচার বিভাগের প্রধান। সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠান ঐ একই ব্যক্তির হাতে। এ কারণেই, লর্ড এটনের একটি বিখ্যাত উক্তি অমর হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে পারে। কিন্তু, অসীম ক্ষমতা নিশ্চিতভাবেই মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। ক্ষমতা বাড়াতে সংবিধানকে বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এই সংবিধানের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনে যাকেই ক্ষমতায় বসাবেন, তিনিই ক্ষমতার জোরে দানব হতে বাধ্য। শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা চাই।
পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করার দাবি জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, সংবিধানের এক তৃতীয়াংশ কখনোই বাতিল করা যাবে না, এটা কোনও যৌক্তিক কথা নয়। সংবিধান সংশোধন করে গণভোট দেওয়ার বিধান থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা করেনি। আমি মনে করছি, কেউ রিট করলেই মহামান্য আদালত বিষয়টি মঞ্জুর করবেন। সংবিধান সংশোধন করে গণমুখী এবং জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যবস্থা করতে হবে।
‘জাতীয় নির্বাচনের আগে আমরা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চাই। তবেই, আমরা বুঝতে পারবো নির্বাচন বিষয়ে কতটা সংস্কার হলো, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না। যারাই ক্ষমতায় আসুক তারা যেন দানব না হতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। ব্যক্তিগতভাবেও আমরা তাদের বিশ্বাস করি’ বলেন জাপার চেয়ারম্যান।
গোলাম কাদের বলেন, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিএনপি একদলীয়ভাবে নির্বাচনের আয়োজন করেনি? আমার তো সেই নির্বাচনও বর্জন করেছিলাম। ওয়ান ইলেভেন এসে সেই নির্বাচনের সব পরিকল্পনা শেষ করে দেয়। ২০০৮ সালে আমরা মহাজোট করেছিলাম দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও দলীয়করণের প্রতিবাদে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন করেছিল। জনগণ মনে করেছিল আওয়ামী লীগ ভালো কাজ করবে, আমারও ভেবেছিলাম তাই। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতির সকল রেকর্ড ভেঙে ফেলেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন আমরা বর্জন করেছিলাম।
তিনি বলেন, আমাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছিলেন, সব দল না এলে আমরা নির্বাচনে যাব না। তিনি বলেছিলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য প্রয়োজন হলে নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন করা হোক। তারপর আওয়ামী লীগ চিকিৎসার নামে আমাদের নেতাকে আটক করে রেখেছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে আমি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিই। আমিসহ ২৭০ জন নির্বাচন বর্জন করেছিলাম। আমি নিজেও ২০১৪ সালের নির্বাচন করিনি আর সংসদেও যাইনি। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে গিয়ে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দিয়েছে এই অভিযোগ কি সত্য? আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচন পদ্ধতিতে ২০১৪ সালের মেয়র ও কয়েক ধাপ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি? আওয়ামী লীগের অধীনে তাদের নির্বাচন পদ্ধতিতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে সকল দলই অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে জাতীয় পার্টি যদি স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে বৈধতা দিয়ে থাকে তাহলে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও ২০১৪ সালের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়ে কি আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা দেয়নি? ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির সংসদ সদস্যরা চার বছর সংসদে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাহলে আওয়ামী লীগের অধীনে কি শুধু আমরাই নির্বাচনে গিয়েছিলাম? সব দলই আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে গিয়েছিল। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলেন আমাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তা তিনিই ভালো জানতেন। তবে, আমরা বিরোধী দলের ভূমিকা ঠিকমতই পালন করেছি। ২০১৮ থেকে ২০১৪ মেয়াদে আমাকে সংসদের উপনেতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারণ, সংসদে আমি কঠিন কথাগুলো বলতাম। আমাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন করা হয়েছিল। স্পিকার বেআইনিভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন না। কারণ, আমি সংসদে সব সময় সত্য কথা বলেছি। সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সব সময় কথা বলেছি। কোন অনৈতিক কাজে আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিই নাই। রাজনীতি করতে গেলে একটি দল দরকার হয়। আবার, সঠিক রাজনীতি না থাকলে দলও থাকে না। শুধু দল বাঁচাতে কিছু কম্প্রোমাইজ করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করুন, এমন অবস্থায় আপনি হলে কি করতেন? বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপি ও জামায়াতকে মামলা ও হামলা দিয়ে আর জাতীয় পার্টিকে বিভক্ত করে ধ্বংস করতে চেয়েছে। আমরা জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দল বাঁচাতে চাইনি। আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের কোনও সংলাপ হয়নি, আমরা সব সময় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চেয়েছিলাম। অপপ্রচার চালানো হয়েছে, আমি নাকি স্ত্রীর আসনের জন্য নির্বাচনে গিয়েছিলাম। এটা সম্পূর্ণ অসত্য। আমাদের দলকে এবং আমাদের ব্যক্তি ইমেজকে ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় যুব সংহতি’র সভাপতি এইচ এম শাহরিয়ার আসিফের সভাপতিত্বে এবং জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও যুব সংহতি’র সাধারণ সম্পাদক আহাদ ইউ চৌধুরী শাহীনের পরিচালনায় মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাড. মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, জহিরুল ইসলাম জহির, আতিকুর রহমান আতিক, শেরীফা কাদের, মো. জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, মো. আরিফুর রহমান খান, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মো. খলিলুর রহমান খলিল, ভাইস চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম সরু চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, সম্পাদকমণ্ডলী অলিউল্ল্যাহ মাসুদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, এমএ রাজ্জাক খান, ইঞ্জিনিয়ার এলাহান উদ্দিন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন— মো. হেলাল উদ্দিন, দ্বীন ইসলাম শেখ, মো. এমরানুল হক, অ্যাড. মাঈন উদ্দিন মাইনু, আবু নাসের বাদল, ফররুখ আহমাদ, মো. হাসানুজ্জামান নাজিম, মো. মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর, রিপন ভাওয়াল, আব্দুল হামিদ, ওমর আলী মান্নাফ, অ্যাড. খন্দকার ফিরোজ আহমেদ, মো. দুলাল মৃধা, মো. মারুফ ইসলাম তালুকদার প্রিন্স, রাহুল দেব, শাহান উদ্দিন নাজু, প্রভাষক মো. রফিকুল ইসলাম, শরীফ উদ্দিন, শাহ আনোয়ারুল অনু, আশরাফুল ইসলাম রুমন, আশিকুর রহমান বাপ্পী, আবু তাহের, আরিফুল ইসলাম রুবেল, মর্তুজা আহমেদ চৌধুরী, অ্যাড. শামীম, মো. গোলাম মোস্তফা হীরা, মাহমুদ আলম, অধ্যাপক নুরুল বশর সুজন।
নঈমুদ্দীন/এনএইচ