দুর্নীতি মামলা
চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েও সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে শহীদুল
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কুর্মিটোলার তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শহীদুল আফরোজ। দুর্নীতির কারণে যেখানে তার সাসপেনশনে থাকার কথা, সেখানে সিভিল অ্যাভিয়েশনের মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তিনিই এখন সর্বেসর্বা। আওয়ামী লীগের দলীয় লোক বিবেচনায় প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন ‘দুর্নীতিবাজ’ এই শহীদুল। জানা গেছে, পতিত সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিমান পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের তদবিরের জোরে জনপ্রশাসনের রুটিন/চলতি দায়িত্ব প্রদানের শর্ত ভঙ্গ করে তাকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েও তদবিরের জোরে মানবিক কোটায় ‘তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী’র পদে ফিরে আসেন বিতর্কিত এই শহীদুল। সরকার পতনের ছয় মাস আগে ভাগিয়ে নেন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনার প্রধান প্রকৌশলীর পদটিও। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বেবিচক ও সরকারি কর্মচারী বিধি অনুযায়ী দুর্নীতি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যেখানে তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই, সেখানে সাবেক আইনমন্ত্রীর ঘনিষ্ট লোক হওয়ায় তারই নির্দেশে তারই মন্ত্রণালয়ের ‘আইনি মতামত’ দেখিয়ে তার মত চার্জশিটভুক্ত আসামির বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে পূর্বের পদে বহাল করা হয়।
শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে তাকে সরকারি শর্ত ভঙ্গ করে সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী (সিনিয়র) পদে ৬ মাসের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর তার নিয়োগের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। মেয়াদ বাড়াতে হলে বোর্ডের অনুমতি লাগবে কিন্তু শহীদুলের ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমতি প্রয়োজন হয়নি। এভাবেই তিনি পদে পদে সকল সরকারি আইনকানুন ও বিধি লঙ্ঘনের রেকর্ড গড়েছেন তিনি। বিতর্কিত শহীদুলকে এই পদে বসাতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির নজির স্থাপন করেছেন বেবিচক কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, সিভিল অ্যাভিয়েশনের মত স্পর্শকাতর স্থাপনায় দুর্নীতির মাধ্যমে প্রধান প্রকৌশলী পদে পতিত সরকারের দোসর শহীদুল বহাল তবিয়তে রয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিকে পদ থেকে দ্রুত অপসারণপূর্বক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দাবি জানিয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ দিয়েছেন। অন্যথায় তারা আন্দোলনের পথে হাঁটবেন বলেও জানিয়েছেন।
বেবিচক কর্তৃপক্ষের প্রকৌশল শাখার সর্বস্তরের প্রকৌশলীগণের পক্ষ হতে গত ২২ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগে বলা হয়, সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী পদটি আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন। প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুদকের একটি অর্থ কেলেঙ্কারি (কক্সবাজার জেনারেটর) মামলা এখনো চলমান রয়েছে। ওই মামলায় তাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ফলে এমন একজন চার্জশিটভূক্ত মামলার আসামিকে চিফ প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পতিত সরকারের বিমান-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এবং তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের তদবিরে জেনারেটর ক্রয়ের নামে আত্মসাতের বিভাগীয় মামলায় ‘দোষী সাব্যস্ত’ হওয়ার পরও লঘুদণ্ড প্রদান করে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। ‘মানবিক’ কারণ দেখিয়ে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার ও সপদে যোগদানের সুপারিশও করা হয়। তারপর ওপরের পদে রুটিন দায়িত্ব দিয়েছেন, যা বেবিচকের সংবিধান পরিপন্থী।
অভিযোগে প্রকৌশলীরা বলেন, সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হলেও উনাকে কোনও আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। সিভিল অ্যাভিয়েশনের বেশিরভাগ উন্নয়নমূলক কাজ, সেবা ও মালামাল ক্রয় প্রকৌশল শাখা থেকেই হয়ে থাকে। তাই প্রকৌশল শাখার কার্যক্রমের সাথে অর্থের সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি। তাই আর্থিক ক্ষমতা না থাকলেও রুটিন দায়িত্ব দেওয়ার কারণে উনার স্বাক্ষরে কিংবা লিখিত অনুমতিক্রমে যে সকল আর্থিক কাজ করা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে পরবর্তীতে অডিট আপত্তি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রধান প্রকৌশলীর কারণে তার ঊর্ধ্বতনরাও অডিটের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তারা বলেন, দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজের বিষয়ে গত ১৯/০৫/২০২৩ তারিখ (সূত্রঃ ০৫.০০.০০০০.১৭৩,২৭.০০২.১৮-৯৭) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে মতামত দিয়েছেন, তা হলো দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে সাময়িক বরখাস্ত এবং মামলাটি নিপত্তি না হওয়ায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১ এর অনুচ্ছেদ-৬৭ এবং সরকারি কর্মচরি আইন, ২০১৮ অনুসারে সাময়িক বরখাস্তে আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। তাই অবিলম্বে তাকে অপসারণ করে ডিপিসির মাধ্যেমে নতুন প্রধান প্রকৌশলী নির্বাচনের আবেদন করছি।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের জোর তদবিরে দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হিসেবে ‘অযোগ্য’ বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজকে ‘যোগ্য’ দেখিয়ে সরকারি বিধি ভেঙে একইসঙ্গে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী রুটিন দায়িত্ব প্রদান, ছয় মাসের নিয়োগের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া, বিভাগীয় মামলায় লঘুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া সত্বেও ‘মানবিক বিবেচনার’ অজুহাতে একজন ফৌজদারি আসামিকে সরকারি কর্মচারী ও বেবিচকের আপত্তি অমান্য করে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে সপদে বহাল রাখাসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া জানান, সব বিষয়ে অবগত হয়েছি। বিষয়টি দেখছি। এ বিষয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রকৌশলীদের আবেদন পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেয়েছি। সামনে ডিপিসির সভা আছে, আমরা এ বিষয়টি সেখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
দুদক সূত্র জানায়, বেবিচকের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। বেবিচকের তত্ত্ববাধয়ক প্রকৌশলীর দায়িত্বে থেকে সিন্ডিকট করে কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য দরপত্র অনুযায়ী জেনারেটর না কিনে ঠিকাদারকে বিল প্রদান ও সেই টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শহীদুল আফরোজসহ ছয়জনকে আসামি করে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-পরিচালক মোহা. মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি কক্সবাজার মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলায় বলা হয়, বেবিচকের তত্ত্বাবাধয়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ টেন্ডার ও প্রাক্কলনের শর্তানুযায়ী, কক্সবাজার বিমানবন্দরে ঠিকাদার কর্তৃক নির্ধারিত ইউকেতে ফ্যাটকৃত কোনরকমের জেনারেটর সরবরাহ না করেই ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের লাভবান করার উদ্দেশ্যে ঠিকাদারের অনুকূলে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিল চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে অন্যায়ভাবে সহযোগিতা করে উত্তোলনপূর্বক পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাত করেছেন।
শহীদুল আফরোজ ছাড়াও মামলায় আসামি করা হয়- ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স ঢাকা ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. শাহাবুদ্দিন, বেবিচকের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র সরকার, সাবেক সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম মন্ডল, কক্সবাজার বিমানবন্দরের সাবেক ব্যবস্থাপক হাসান জাকির, নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে।
এজাহারে বলা হয়, ২০১৪ অর্থবছরে কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য একটি তিনশ কেভিএ জেনারেটর ক্রয়ের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি পায় মেসার্স ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. শাহাবুদ্দিন ৬৯ লাখ ৯৭ হাজার ৪০৬ টাকায় দরপত্র দাখিল করেন। পরবর্তীতে বিদেশি এই জেনারেটরটি গত ১৮.০৬.২০১৫ তারিখে কক্সবাজার বিমানবন্দরের হাওয়ার হাউজে সঠিকভাবে স্থাপন করা হয়েছে মর্মে বেবিচকের সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম মণ্ডল, সহকারী প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র সরকার ও কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাসান জাকির প্রত্যয়ন করেন। গত ২৯.০৬.১৫ তারিখে কাজের মেজারমেন্ট বই প্রস্তুত করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে। প্রকল্পকার্য সম্পাদনের জন্য গত ৩০.০৬.১৫ তারিখে বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ ও সিনিয়র হিসাবরক্ষক তুষার কান্তি দেওয়ানের স্বাক্ষরে প্রথম কিস্তির ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়।
আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা ও জাল জালিয়াতি করে নিজ নিজ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজে লাভবান হয়ে এবং অপরকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে টেন্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত জেনারেটর সরবরাহ না করে ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিল উত্তোলন পূর্বক আত্মসাৎ করে ৪০৬/৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৫ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদক জানায়, দুর্নীতি মামলা দায়ের হওয়ার পর জামিন নিতে আসলে বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজকে গত ১২.০২.২০১৯ তারিখে কক্সবাজার দায়রা জজ আদালত জেলা কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন। দুর্নীতি মামলায় জেলা কারাগারে যাওয়ার আদেশের কারণে ২০১৯ সালের ৩ মার্চ বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত আদেশ জারি করেন। কক্সবাজার বিমান বন্দরে জেনারেটর ক্রয়ে দুর্নীতি মামলার তদন্তে শহীদুল আফরোজসহ পাঁচজনের জড়িত থাকার সত্যতা পেয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় দুদক। কক্সবাজারের বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চার্জশিট আমলে নিলে ২৩ মার্চ ২০২০ তারিখে শহীদুল আফরোজসহ আসামিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালুর জন্য বেবিচককে নির্দেশনা দেয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। একই আদেশে তাদের সাময়িক বরখাস্ত বহাল রাখার আদেশ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে বেবিচক শহীদুল আফরোজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করেন। বিভাগীয় মামলা চলাকালে মামলা দ্রুত নিস্পত্তির জন্য তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আপিল করেন। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিলে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে আইনগত মতামত চাওয়া হয়। মন্ত্রণালয় বেবিচকের কর্মচারী চাকরি প্রবিধান মালা ২০২১ এর ৬৮ (২) (গ) প্রবিধি অনুসারে চলমান মামলা নিস্পত্তি করার বিষয় বলা হয় এবং আরও বলা হয় যে, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের আদেশ মান্য করে বিধি মোতাবেক বিভাগীয় মামলা নিস্পত্তিতে কোনো বাধা নেই। তবে, বিদ্যমান বিধিবিধানের আলোকে বিভাগীয় মামলা নিস্পত্তি হলেও ফৌজধারি মামলা চলমান থাকায় ও ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার হওয়ায় তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর বেবিচক বিভাগীয় মামলার তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে আসামি শহীদুলের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে লঘুদণ্ড প্রদানপূর্বক বিভাগীয় মামলা নিস্পত্তির সিদ্ধান্ত হয়।
গত ১১.০৫.২১ তারিখে প্রদত্ত তৎকালীন বেবিচক চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, বেবিচকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বেবিচকের কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ১৯৮৮ সালের ৪০ (১) (ক) (আ) প্রবিধি তথা বেবিচকের কর্মচারী প্রবিধানমালা ২০২১ সালের ৫০ (১) (ক)(আ) প্রবিধি মোতাবেক শহীদুল আফরোজ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সাময়িক বরখাস্ত) এর ২০২০ সালের বার্ষিক বেতন বর্ধন একবছরের জন্য বকেয়া না পাওয়ার শর্তে স্থগিত করা হলো। বিভাগীয় মামলায় আনিত অভিযোগ এতদ্বারা নিস্পত্তি করা হলো। বিভাগীয় মামলাটি নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শহীদুল আফরোজ ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়ায় ও মামলা চলমান থাকায় ঐমামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ যথারীতি বলবৎ থাকবে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, বিভাগীয় মামলায় দোষী সাব্যস্ত এবং দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েও ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন অবস্থায় শহীদুল আফরোজ বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হিসেবে প্রভাব প্রতিপত্তি দেখিয়ে যে কোনো মূল্যে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে ফিরে আসার তদবির শুরু করেন। এক্ষেত্রে ব্যবহার করেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক বিমান পর্যটনমন্ত্রী মাহবুব আলীকে। এজন্য তিনি জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। বিভাগীয় মামলার নিস্পত্তির আগেই শহীদুল আফরোজের বিভাগীয় মামলা ও সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহারের বিষয়ে গত ২৪ মার্চ ২০২১ তারিখে বিমান মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা দেন। সেখানে বলা হয়, বেবিচক এর কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ২০২১ এর প্রবিধি ৫৫ (৪) অনুসারে ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার হলে গ্রেপ্তারের তারিখ হতে তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত বলে গণ্য হবেন। তাছাড়া বাংলাদেশে সার্ভিস রুলস (পার্ট-১) এর বিধি ৭৩ ও সরকারের অন্যান্য আদেশাবলীতেও অনুরূপ বিধান রয়েছে। তাই বিভাগীয় মামলা নিস্পত্তি হলে ও উক্ত বিভাগীয় মামলায় সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার হলেও তাকে তাৎক্ষণিকভাবে পুনারায় সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। তাই প্রকৃতপক্ষে সাময়িক বরখাস্তকৃত মো. শহীদুল আফরোজ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নাই। এতকিছুর পরও বসে থাকেননি শহীদুল আফরোজ। তিনি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বুদ্ধি-পরামর্শে গত ১৫ মে ২০২১ তারিখে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে বিভাগীয় মামলায় প্রদত্ত ‘বরখাস্ত আদেশ’ প্রত্যাহার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেন। তিনি তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারে বেবিচকের চেয়ারম্যান বরাবরে আবেদন করেন। একইসঙ্গে তিনি একাদশ সংসদের বিমান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে আবেদন জানান। তার আবেদন পেয়ে বেবিচক এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চাইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় শহীদুলের বিষয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে নির্দেশনা প্রদান করে। অন্যদিকে বিমানের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩৪তম সভায় তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার এবং স্বপদে বহাল রাখার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে মানবিক দিক বিবেচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সংসদীয় কমিটির সুপারিশে গত ১৭ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় শহীদুল আফরোজের বিষয়ে মতামত প্রদান করেন।
এতে বলা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে সাময়িক বরখাস্ত করায় এবং উক্ত মামলাটি নিস্পত্তি না হওয়ায় বেবিচকের কর্মচারী প্রবিধানমালা ২০২১ এর অনুচ্ছেদ ৬৭টি অনুযায়ী এবং সরকারি কর্মচারী চাকরি আইন ২০১৮ অনুযায়ী বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নাই। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের মতামত, এর আগে বিমান মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট মতামত, বেবিচকের বিভাগীয় মামলার রায়; বিশেষ করে বেবিচকের প্রবিধানমালা ও সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী দুর্নীতি মামলার মত ফৌজাদারি মামলার চার্জশিটভূক্ত আসামি যেখানে কোনোভাবে মামলার নিস্পত্তি হওয়ার আগে সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার এবং স্বপদে বহাল করার সুযোগ নাই সেখানে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের তদবিরে তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারে বেবিচক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে গত ৩০ মে ২০২৩ তারিখে আইন মন্ত্রণালয় থেকে আইনগত মতামত প্রদান করা হয়।
পরবর্তীতে শহীদুল আফরোজ এই মতামত নিয়ে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করিয়ে স্বপদে বহাল হতে মরিয়া হয়ে উঠে। পতিত সরকারের সাবেক বিমানমন্ত্রী মাহবুব আলীর তদবিরে বেবিচকের চেয়ারম্যান গত ২৬ জুন ২০২৩ তারিখে এক আদেশে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের আলোকে উল্লেখ করে শহীদুল আফরোজের সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। অথচ আইন মন্ত্রণালয় সরাসরি শহীদুলের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেননি। বরং বলেছিলো, বেবিচক এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু বেবিচক কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেই সিদ্ধান্তের কথা বেবিচক চেয়ারম্যান তার উক্ত আদেশে উল্লেখ করেননি। বরং আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের দোহাই দিয়ে তার সাময়িক আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এভাবেই শহীদুল আফরোজকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদে বহাল করা হয়। এই অনিয়মে পতিত সরকারের দোসর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও বিমানমন্ত্রী মাহুবুব আলীর সঙ্গে বেবিচকের চেয়ারম্যানও জড়িত ছিলেন অভিযোগ আছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি বিধি বিধানের রেকর্ড ভেঙে সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদে থেকে শহীদুলের এবার চোখ পড়ে সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলীর পদে। গত ৩১ জানুয়ারি বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলীর পদ শূন্য হলে ওই পদ ভাগিয়ে নিতে জোর তদবির করেন তিনি। ডিপিসির মাধ্যমে প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ না করে উক্ত শূন্য পদে রুটিন দায়িত্ব দেওয়ার জন্য বেবিচক মন্ত্রণালয়ে শহীদুলের মত একজন ফৌজদারি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামির নাম প্রস্তাব করেন। সরকারি বিধি ও বেবিচকের বিধি অনুযাযী যেখানে দুর্নীতি মামলার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যেখানে তার সামিয়ক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করার সুযোগ নাই সেখানে তার পদের একধাপ উপরে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে রুটিন দায়িত্বে তাকেই একমাত্র যোগ্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এমনকি একধাপ উপরের পদে চলতি দায়িত্ব কিংবা রুটিন দায়িত্ব দিতে জনপ্রশাসনের শর্ত ভঙ্গ করা হয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে তাকে পরবর্তী নির্দেশনা প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে চলতি দায়িত্ব প্রদানের শর্তাবলীতে বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর নামে বিভাগীয় মামলা কিংবা ফৌজদারি মামলার কাযধারা চলমান থাকিলে তাহাকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা যাইবে না। সুনির্দিষ্টভাবে শহীদুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা বিচারাধীন জানার পরও পতিত সরকারের লোক হিসেবে আইনকানুন লঙ্ঘন করে বেবিচক তাকে এই দায়িত্ব প্রদান করে। শুধু কি তাই, আইনে চলতি দায়িত্ব কিংবা রুটিন দায়িত্ব ছয় মাসের জন্য দেওয়া হয়ে থাকে বলা হলেও সেই মেয়াদোউত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বরং নিয়ম না মেনে তাকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এভাবেই দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি শহীদুল আফরোজ পতিত সরকারের লোক হিসেবে সরকারের সকল আইনকানুন লঙ্ঘন করে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদে একইসঙ্গে উপরের পদ প্রধান প্রকৌশলীর পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচকের রুটিন দায়িত্বপালনকারী প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিমানমন্ত্রীর জোর তদবিরের কথা অস্বীকার করেন।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি মামলা নিস্পত্তি হতে ছয় বছর লাগবে এজন্য আমি কী বসে থাকবো, না খেয়ে থাকবো। অর্ধেক বেতনে সেই লোকটা চলে কীভাবে। যেই জেনারেটর নিয়ে মামলা সেটা তো চলমান রয়েছে। বিভাগীয় মামলায় নিস্পত্তি করেছে, ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করে। বিভাগের কোনো আপত্তি নেই। তাছাড়া প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালও বলেছে, লংটাইম পাবলিক চাকরিজীবীকে বরখাস্ত রাখা যাবে না। তারপরও তারা আমার বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে না। পরে আমি সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারে সরকারের মিনিস্ট্রিগুলোতে আবেদন করেছি, তারা করেছে, এখানে আমার তো কিছু করার নাই। আইন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি, তারা সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহারে মতামত দিয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় সরাসরি বরখাস্ত প্রত্যাহারে কোনো মতামত দেননি বরং মন্ত্রণালয়ের মতামতে জনপ্রশাসনের আপত্তি উল্লেখ করেই বেবিচকের চেয়ারম্যান এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন বলে মতামত দিয়েছেন, এর জবাবে শহীদুল আফরোজ বলেন, আমার আবেদনের ভিত্তিতে তারা প্রত্যাহার করেছে, এখানে আমার কী করার আছে?
জনপ্রশাসনের বিধি ভেঙে দুর্নীতি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া প্রসঙ্গে এই প্রধান প্রকৌশলী বলেন, মামলা তো ছয় বছর ধরে চলছে, লিগ্যাল কী ইলিগ্যাল সেটাই তো জানি না। দশ বছরেও মামলা শেষ হবে না। মামলার কারণে মানুষের জীবন যে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, সেটা তো কেউ বলছে না।
তিনি বলেন, রুটিন দায়িত্ব দেওয়া আমার দৃষ্টিতে ঠিক আছে। যেখানে বাইরের লোক চুক্তিভিত্তিক দুবছর রুটিন দায়িত্ব পালন করে গেছে, সেখানে আমি করলে দোষ। তাছাড়া আমি মোস্ট সিনিয়র। জ্যেষ্ঠতা হিসাব করলে আমি পাই। এ বিষয়ে আপনি সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন।
/এনএইচ/