ট্রাম্প: অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
রিটন খান || রাইজিংবিডি.কম
সাম্প্রতিক পেনসিলভেনিয়ার টাউন হলের এক ইভেন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণ অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। সাধারণ প্রশ্নোত্তর পর্বে ট্রাম্প প্রায় চল্লিশ মিনিট তার পছন্দের প্লে লিস্টের সংগীত-রাজ্যে হারিয়ে যান, তিনি যেন নিজের এক মিউজিক্যাল অনুষ্ঠানের ডি.জে.। মুহূর্তটি ছিল বিস্ময়কর! কারণ এতে ট্রাম্পের এক ভিন্ন আর অপ্রত্যাশিত দিক উন্মোচিত হয়— এতে অনন্য এক রাজনীতি-ধারা এবং নেতারূপ প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন মুহূর্ত নয়, বরং ট্রাম্পের পুরো রাজনৈতিক জীবনের এক প্রতীকী উপস্থাপনা। ২০১৬ সাল থেকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ভিন্ন; যেখানে তিনি রাজনীতির প্রচলিত-ধারা ভেঙে এক নতুন-ধারা স্থাপন, জনতার আকর্ষণ বৃদ্ধি, আর বিরোধীদের মনে এক আতঙ্কও সৃষ্টি করেছেন।
ট্রাম্পের বিন্যাসহীনতা; যার মাধ্যমে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রচলিত নিয়মগুলো উপেক্ষা করে কথা বলেন আর কাজ করেন— তার নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। ট্রাম্পের এই বিন্যাসহীনতাকে আমরা তার শক্তি এবং দুর্বলতা উভয়ই বিবেচনা করতে পারি। তিনি এমন একজন নেতা যিনি অন্যদের মতো নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে বাঁধেননি; কখনওবা রুক্ষ, কখনওবা সমালোচনামূলক বক্তব্যে তিনি বেপরোয়া। ফলে তিনি সমর্থকদের মধ্যে এক ধরনের ‘কারিশমা’ তৈরি করতে পেরেছেন। সমর্থকেরা মনে করেন ট্রাম্প যা বলেন, তা অন্য কেউ বলার সাহসও পান না।
যদিও এই বিন্যাসহীনতা অনেক সময় জনসমক্ষে তার গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়েছে, একইসঙ্গে নেতৃত্বের গভীর-সংকটের ইঙ্গিতও বহন করেছে। তার অসংযত মন্তব্য আর কর্মকাণ্ড প্রায়শই অস্বাভাবিক বা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়েছে; যা স্বাভাবিক রাজনৈতিক-ভাষা থেকে বহুদূরে।
রাজনীতিবিদদের বয়স আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নেতৃত্বের উৎকর্ষতা, প্রজ্ঞার বিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রত্যাশিত বিষয়। সেক্ষেত্রে ট্রাম্পকে দেখলে মনে হয় সেই ২০১৬ সালের আজ হতে আটবছর পূর্বের একই মানুষ। ট্রাম্প নিজে বলেন, ‘আমি প্রথম শ্রেণি থেকে এখন পর্যন্ত সেই একই রকম আছি।’ এই উক্তিটি তার নিজের ব্যক্তিত্ব এবং চিন্তাধারার স্থবিরতাকে তুলে ধরে। চরিত্রে বয়সের কোনো ছাপ পড়েনি বলেই মনে হয়; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে আরও একরোখা এবং অনিয়ন্ত্রিত করে তুলেছেন।
এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলতে হয়— কেন ট্রাম্পের আচরণ নিয়ে গণমাধ্যম এতটা বিভ্রান্ত? এর একটি প্রধান কারণ হতে পারে, ট্রাম্পের রাজনীতির ভাষা আর চিন্তাভাবনার ধরন প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে। তার আচরণ, বক্তৃতা এবং চিন্তাভাবনা অন্য নেতাদের তুলনায় অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক। তার অসংলগ্ন বক্তৃতা বা কখনও কখনও কল্পনাপ্রসূত বক্তব্যকে মিডিয়া সহজে সংজ্ঞায়িত করতে পারেনি। যেখানে জো বাইডেনের বয়স আর নেতৃত্ব নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আলোচনা হয়েছে, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তেমন সমালোচনা কার্যকরভাবে ধরা পড়েনি।
গণমাধ্যমের ভূমিকা এখানে এক বিভ্রান্তিকর মায়াজাল তৈরি করেছে। বাইডেনের বয়সের কারণে তার নেতৃত্বের সম্ভাবনা নিয়ে গণমাধ্যম প্রায়শই প্রশ্ন তুলেছে, ট্রাম্প প্রায় সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও তার আচরণ নিয়ে তেমন কোনো জোরালো সমালোচনা আমরা দেখতে পাইনি। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, ট্রাম্পের ব্যক্তিত্বকে বুঝতে অক্ষমতা আর তার মানসিকতার গভীরতায় প্রবেশে জটিলতা।
ট্রাম্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল ছিল নিজের চারপাশের নিয়ন্ত্রিত মানুষকে ব্যবহার করে অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তগুলোকে কার্যকর করা। যদিও প্রথম মেয়াদকালে তার অনেক কর্মসূচি প্রশাসনিক অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণের কারণে অকার্যকর ছিল; বর্তমানে যারা তাকে আসন্ন-মেয়াদের জন্য প্রস্তুত করছে, তারা এই বাধাগুলো দূর করতে প্রবল সচেষ্ট। ট্রাম্পের সব সিদ্ধান্তই যেন এ যাত্রায় বাস্তবায়িত হয় ছেলে ডন জুনিয়রসহ অন্যরা এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ অবস্থায়, ট্রাম্পের বিন্যাসহীনতাকে কেবল তার ব্যক্তিক অভ্যাসের মতো সামান্য বিষয় ভাবা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়, বরং এমন উদ্দেশ্যমূলক আচরণ আমেরিকার রাজনীতিতে এক বড় বিপজ্জনক-ধারা সৃষ্টি করছে। তার সমর্থকরা মনে করে, ব্যক্তিত্বই তাকে রাজনীতিতে সফল করেছে। কিন্তু তার নেতৃত্বের এই অপ্রতিরোধ্য বিন্যাসহীনতা নিজ বা রাষ্ট্রের রাজনীতির ভিত আরও অস্থিতিশীল করতে পারে। প্রচলিত-ধারার বাইরে গিয়ে বিন্যাসহীনতার এক নতুন ধারা তৈরি করে ইতিহাসে অনন্য হওয়ার চেষ্টা হয়তো তিনি করছেন। কিন্তু একইসঙ্গে নেতৃত্বের অযোগ্যতাকেও তিনি তুলে ধরেছেন।
ভবিষ্যত-ট্রাম্পের দিকে তাকালে দেখতে পাই, তার নিজের চারপাশের মানুষ আর প্রতিষ্ঠানগুলো তার মতোই বিভ্রান্ত এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। পূর্বে যখনই ট্রাম্প নিজের কর্মকাণ্ডে অস্থিতিশীল ভাব প্রকাশ করেছেন, তখনই তার প্রশাসনিক লোকের মধ্যে প্রতিরোধে এক অক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এটাই আমেরিকার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা যখন নেতৃত্ব বিন্যাসহীন হয়, তখন গোটা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোই বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন হয়।
ট্রাম্প এভাবেই আমাদের এক বিভক্ত আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেন, যেখানে রাজনীতির মূলধারার ধ্বংসের আশঙ্কা প্রচণ্ড প্রবল।
তারা//