ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

৭ নভেম্বর: পাঠ ও বিবেচনা

ড. কাজল রশীদ শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৯, ৮ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১০:২১, ৮ নভেম্বর ২০২৪
৭ নভেম্বর: পাঠ ও বিবেচনা

৭ নভেম্বর নিয়ে নানা মত হাজির রয়েছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে তো বটেই বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকাণ্ডেও। এই নিয়ে নানা তর্ক, বিতর্ক ও কুতর্ক হামেশাই শোনা যায়। তর্ক-বিতর্ক থাকা ভালো লক্ষণ, কিন্তু কুতর্ক থাকাটাই বিপদের। বেদনার হলেও সত্য যে, সেই কুতর্কের আবাদ প্রায় পাঁচ দশক ধরে প্রবহমান রয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রমরমা প্রসারের ফলে। অতীত নিয়ে আমরা যদি এক না হতে পারি, সবার যদি এক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন না থাকে তা হলে সামনের দিকে এগোনো মুস্কিল। বর্তমান ও ভবিষ্যতকে জয় করা কঠিন ও দুরুহ। এ কারণে অতীতের নানা রকম অভিজ্ঞতা থাকার পরও সবার জন্যই করণীয় হলো, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগোনোর পথকে সুন্দর ও সংহত করা।

প্রত্যেক জাতির জীবনেই থাকে ঘটনাবহুল অতীত। বাঁক বদলে যাওয়া সব ইতিহাস। সেসবের সবই যে শুভ্রতায় ভরা তা কিন্তু নয়। বরং এসব সেসব জাতির ইতিহাসে থাকে না, যাদের অতীত নেই। যারা সদ্যোজাত শিশুর মতো আজ-কাল কিংবা পরশু জন্মিয়েছে। জাতি হিসেব আমরা যেহেতু কয়েক হাজারের বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের উত্তরসূরি। সুতরাং আমাদের অতীতে মোচড়ানো সব ঘটনা থাকবে; আলো-আঁধারিতে ভরা সব অধ্যায় থাকবে; তা নিয়ে নানারকমের অনুসন্ধান ও কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন উচ্চারিত হবে। এবং এটাই স্বাভাবিক, সঙ্গত ও যৌক্তিক।

কিন্তু সেই অতীতকে টেনে এনে বিভাজন বাড়ানো যাবে না। বরং এসব উন্মীলন ও চর্চার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য থাকবে মিলিত হওয়ার প্রয়াস। মেলাবে আর মিলিবে’কে দেখা হবে সকলের তাড়না রূপে। এটা দূর অতীত সম্পর্কে যেমন প্রযোজ্য, নিকট অতীত সম্পর্কেও তাই। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান পরবর্তীতে যে নতুন আকাঙ্ক্ষার পথে হাঁটঁছে বাংলাদেশ, সেই আকাঙ্ক্ষাও পূরণে এই সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করার কোনো বিকল্প নেই। নব আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশে বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। উনাদের দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক তিন মাসের মাথায় হাজির হয়েছে ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যাপূর্ণ দিন। যদিও এই দিবসটিকে ঘিরে তিনটা মত ও পন্থা হাজির রয়েছে। এর বাইরে নানা মুনির নানা মত তো রয়েছে। অথচ সময়বিচারে আমরা ওই ঘটনার পর প্রায় অর্ধশতক পেরোতে যাচ্ছি। ঘটনাটা কিন্তু কোন সামাজিক সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট ও নির্দেশনায় সংঘটিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, আমাদের সার্বভৈৗমত্বের প্রতীক। এ দেশের সকল মানুষের গর্ব ও গৌরবের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ফলে, এরকম প্রতিষ্ঠানের একটা ঘটনাকে ঘিরে নানা মত ও পন্থা থাকা ভালো কোন লক্ষণ নয়। এর মধ্যে দিয়ে একটা দেশের মানুষের চারিত্র্যলক্ষণ যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনই অতীত প্রশ্নে সবারে নিয়ে, সবার হয়ে একটা সংহত অবস্থান প্রশ্নে কতটুকু আন্তরিক ও ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সর্বৈবভাবে কতোটা আগ্রহী- তার একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইংগিত পাওয়া যায়। ৭ নভেম্বর নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিকের খবরের দিকে দৃষ্টি রাখলেও প্রসঙ্গটা স্পষ্ট হয়।

২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বরে ‘প্রথম আলো’র খবরটির শিরোনাম ছিল, ‘আজ ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর’। পুরো অংশই আমাদের সামনে উপস্থাপন করছি।

‘‘ইতিহাসের ঘটনাবহুল ও আলোচিত দিন আজ ৭ নভেম্বর। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন পৃথক নামে দিনটি পালন করে। বিএনপি দিনটিকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে। জাসদ পালন করে ‘সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে। আর প্রগতিশীল অনেক দল ও সংগঠন ৭ নভেম্বরকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ পালন করে।’’

খবরের এই অংশটুকু বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। বলা হচ্ছে. দিনটিকে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে অনেক দল ও সংগঠন। এখানে অনেক দল বলতে মূলত বোঝানো হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। খবরটির শেষাংশে বিষয়টা কিন্তু পরিস্কারও করা হয়েছে।

সেখানে বলা হচ্ছে: ‘‘৭ নভেম্বর ঘিরে প্রতি বছর বিএনপির কর্মসূচি থাকলেও এবার (২০২৩) কোনো কর্মসূচি পালন করবে না দলটি। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ভার্চ্যুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল রিজভী জানান, দলের কেন্দ্রীয় কার্যাল তালাবদ্ধ, নেতাকর্মীদের অব্যাহতভাবে গ্রেপ্তারসহ উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে এবার ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবসের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।

৭ নভেম্বরকে ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আওয়ামী লীগ। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটায় আলোচনা সভা ডাকা হয়েছে। … অন্যদিকে জাসদ আজ বেলা তিনটায় ঢাকায় শহীদ কর্নেল তাহের মিলনায়তনে ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা সভা ডেকেছে।’’

তা হলে এখানে কেন ‘প্রগতিশীল’ শব্দটা আমদানি করা হলো এবং কেনই বা খবরটির শেষাশেষিতে এটাই পরিস্কার করা হলো, ‘আওয়ামী লীগ’ বলতে ইন্ট্রোতে যে ‘প্রগতিশীল’ দল বোঝানো হয়েছে সেটাই। অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম, তা হলে কি ‘জাসদ’ ও প্রগতিশীল দল নয়? এই খবরের মধ্যে একটা বিষয় পরিস্কার যে, আমরা অতীতের প্রশ্নে কতটা বিভাজিত ও পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণু।

খবরের বাকি অংশ হলো: ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে। এরপর ওই বছরের ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। শুরু হয় সেনাবাহিনীতে পাল্টাপাল্টি  অভ্যুত্থানের ঘটনা। এসব ঘটনার একপর্যায়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দী হন। ৭ নভেম্বর এ অভ্যুত্থানে তিনি মুক্ত হন। এর মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি হয়।’

এই খবরের ক্যাপশনটিও বেশ চিত্তাকর্ষক ও আগ্রহোদ্দীপক। ‘৭ নভেম্বরের মূল চরিত্র তিনজন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান, সাবেক ক্ষণস্থায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের।’

এই খবর পাঠে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, ৭ নভেম্বরকে ঘিরে তিনটি রাজনৈতিক দল সক্রিয় এবং প্রত্যেকের স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। অবশ্য এখানে আওয়ামী লীগ যে পক্ষ সেই সময়ের ঘটনা পরিক্রম ও উদ্ভূত পরিস্থিতি বিচারে এই প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে যে এখানে ওরা কীভাবে একটা পক্ষ হওয়ার সুযোগ পায়? সেই সময় তো রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের কোন কার্যাক্রম ছিল না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনকিছুতেই ছিল না। কারণ, ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগের সব কার্যাক্রম অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এটাও পরিস্কার করে বলে নেওয়া ভাল, তখন আওয়ামী লীগ নামক কোন রাজনৈতিক দলই ছিল না। কারণ ততদিনে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ নামে একদলীয় শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছেন। এখন ওরা যে ঘটনার অংশীজন হয়ে উঠল কিংবা দাবি করে সেটা কি ঘটনা ঘটে যাওয়া এবং ফলাফল প্রকাশিত হয়ে পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারিত হওয়ার পর থেকে। অবস্থাদৃষ্টে তাই-ই মনে হয়। যেকোনো ঘটনার সাধারণত দুটি পক্ষ থাকে। কিন্তু ৭ নভেম্বরের ঘটনার তিনটি পক্ষ। রাজনৈতিক দল হিসেবে যাদের পরিচয় বিএনপি, জাসদ ও আওয়ামী লীগ। উল্লেখ্য তখনও বিএনপির জন্ম হয়নি। কিন্তু আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে, ৭ নভেম্বরের ঘটান ও তাৎকালীন প্রেক্ষাপট পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির আবির্ভাবকে নিশ্চিত করে তোলে। এখানে আমরা ৭ নভেম্বরের ঘটনার তিনটা পক্ষ নিয়ে আলোচনা করলেও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, পক্ষ তিনটা নয় চারটা।

‘পঁচাত্তরের অস্থির সময়: ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের অকথিত ইতিহাস; স্মৃতি, দলিল, মতামত’ মতিউর রহমান সম্পাদিত বই। বিশ্বজিৎ চৌধুরী ২০২৪ এর ৪ নভেম্বর ‘পঁচাত্তরের অস্থির সময়: ইতিহাসের খসড়া’ শিরোনামে বইটি নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে সংযোজিত হয়েছে মুক্ত আলোচনা অধ্যায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এখানে বলেছেন, ‘চারটি ভিন্ন আদর্শের শক্তি এই লড়াইয়ে ‍যুক্ত ছিল। যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছিলেন, তাঁরা কেউ আদর্শনিরপেক্ষ ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে আদর্শিক পার্থক্য ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খন্দকার মোশতাক, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে, সে সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মত ছিল।’ ৭ নভেম্বরের প্রশ্নে উনার এই দৃষ্টিভঙ্গি যৌক্তিক। কিন্তু এসবই কি বিভাজনকে আরও বেশি উস্কিয়ে দেয়, নাকি কমিয়ে আনে তারও একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। ১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলেও ওই বছরের নভেম্বর নাগাদ তার ক্ষমতা খর্ব হতে হতে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তখন আর উনি কোন পক্ষ হওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। বলা যায়, মোশতাক কখনোই কোন পক্ষ ছিল না, পক্ষের সুবিধাভাগী হওয়া ছাড়া পক্ষকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা কোনকালেই ছিল না উনার। যার প্রমাণ, বঙ্গবন্ধু কেবিনেটের ২৩ জনের মধ্যে ২১ জন সদস্য উনার সঙ্গে যুক্ত হলেও উনি সেটা যথার্থভাবে পরিচালনা করতে পারিনি।

১৫ আগস্টের শোকাহত অধ্যায়, ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মতো ঘটনাপ্রবাহ ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহকে অনিবার্যা করে তুলেছিল কিনা তা খতিয়ে দেওয়া দরকার। এবং এ কথা তো সত্যি ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যান্ত যে ভয়, শঙ্কা ও ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল জাতি ৭ নভেম্বর তা থেকে মুক্তি দেয়। সদ্য স্বাধীন একটা দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সংহতির প্রশ্নে যে অবিশ্বাস ও ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছিল ৭ নভেম্বর তা থেকে আমাদেরকে নিস্কৃতি দেয়। এই সত্য কি অস্বীকারের সুযোগ আছে, নাকি তেমনটা করা যৌক্তিক ও নৈতিক কোন কাজ হবে।এসব ব্যাপারে ঢাক ঢাক গুড় গুড় কোন কথা নয়, খোলামেলা আলাপা ও সংলাপ হওয়া জরুরি। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ও সম্মিলিত ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে এর কোন বিকল্প নেই।

আমরা মনে করি, ৭ নভেম্বরকে ঘিরে যত প্রশ্ন হাজির রয়েছে, তার উত্তর অনুসন্ধান যেমন জরুরি। তেমনই প্রয়োজন হলো, উত্তরটা জানার পরও আমরা কীভাবে একত্রে বসবাস বা সহাবস্থান নিশ্চিত  করতে পারি তার ওপর গুরুত্বারোপ করা। দিবসটির ভেতর-বাইরের সব দিককে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে জায়গা করে দেওয়া প্রয়োজন। সমাজ-রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যায়তনিক জায়গাগুলো এক্ষেত্রে তাদের করণীয় নিয়েও সভা-সেমিনারের আয়োজন করতে পারে।

বইয়ের প্রসঙ্গে আসি, মতিউর রহমান ওখানে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘‘কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম তাঁর লেখায় ১৫ আগস্ট সপরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত উচ্ছৃঙ্খল কিছু অফিসারকে শায়েস্তা করার যথার্থ হিসেবে বিবেচনা করেন ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে। তিনি লিখেছেন, ‘এই বর্বরগোষ্ঠীকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আমরা উত্খাত করি ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর।’ ৭ নভেম্বরের কথিত সিপাহি বিপ্লবকে তিনি চক্রান্ত ও হঠকারিতার বেশি কিছু ভাবতে পারেননি। তাঁর মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি সেনানায়ক খালেদ মোশাররফ এবং বীর সেনানী কর্নেল হুদা চক্রান্তের শিকার হয়ে ৭ নভেম্বর নির্মভাবে নিহত হন। এদের আত্মত্যাগেই জাতি একদল খুনীর হাতে জিম্মি হয়ে থাকা অবস্থা থেকে মুক্তি পায়। এদিকে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দার, আরও ১০-১২ জন অফিসার (একজন মহিলা ডাক্তারসহ) এবং একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী নিহত হন ৭ তারিখ এবং তত্পরবর্তী কয়েক দিনে।’

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান কুশীলব ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম। অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন:
ক. সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
খ. ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করা।
গ. সংবিধানবহির্ভূত অবৈধ সরকারের অপসারণ, এবং
ঘ. ৬ মাসের মধ্যে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা।’’

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বর ও তার পূর্ববর্তী ঘটাসমূহের প্রেক্ষাপটে আরও একটা পক্ষ কি হাজির হয়? আমরা মনে করি, এগুলো যেকোন ঘটনারই বাস্তবতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিশেষ। যখন কোথাও কোন শুন্যতা দেখা দেয় সেখানে নানাপক্ষ হাজির হওয়া এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নানামুখী ভূমিকা পালন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো, যখন ঘটনার দীর্ঘ সময় পরও একটা দুটো পক্ষ নয়-অনেকগুলো পক্ষ তাতে যুক্ত বা বিযুক্ত থেকেও অতীতের লাভ-ক্ষতির একটা হিস্যা বর্তমানেও বুঝে নিতে তৎপর ও সক্রিয় থাকে।

মতিউর রহমানের বইয়ে আনিসুজ্জামানের অভিমত অবশ্য এসবের বাইরে, অন্য এক চিন্তার খোরাক যোগায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একান্ত দুঃখ এই যে পাঁচ দিনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা কয়েকজন বড় মুক্তিযোদ্ধাকে হারালাম, যারা দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বেও শুন্যতার সৃষ্টি হলো। অবশ্য তার চেয়ে অনেক বেশি শুন্যতার সৃষ্টি হলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এটি একটি বড় ধরনের ক্ষতি সারা দেশের জন্য।’

বইটিকে ভরকেন্দ্রে রেখে মুক্ত আলোচনার উপসংহার টানতে গিয়ে সঞ্চালক মতিউর রহমান বলেছেন, ‘আসলে অতীতের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের একটি সাধারণ সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। তা না হলে আমরা তো আর এগোতে পারছি না।’ মতিউর রহমানের এই ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা মনে করি, ৭ নভেম্বরকে আমরা যদি এভাবে বিশ্লেষণ করি তা হলেও এই দিবসটির তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব। দিবসটির আগের বাংলাদেশ এবং পরের বাংলাদেশের বাস্তবতাটা বোঝাটা জরুরি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেসময়গুলোতে যে ক্যু-পাল্টা ক্যু, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র, নিরাপত্তা ঝুঁকি ও আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল ৭ নভেম্বর তা থেকে মুক্তি দেয়। সেদিন সেই মুক্তির ত্রাতারূপে সবার মাঝে হাজির হয়েছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। দলীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়ে ইতিহাসের এই পাঠ বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৭৫ এর  ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যান্ত দেশে কার্যাত কোন সরকারই ছিল না। স্বাধীনতার বয়স তখন মাত্র চার বছর। আন্তর্জাতিক বিশ্ব ব্যস্ত ভূ-রাজনৈতিক নানাবিধ সমীকরণ মেলাতে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বরূপ কেমন হবে তাও পষ্ট ও পরিস্কার নয়। সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা যেন প্রতিদিনের রোজনামচার অংশ। জনমনেও সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস। রাজনৈতিক দলগুলো লুপ্তপ্রায়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ভয়াবহ রকমের। এই অবস্থায় ৭ নভেম্বর অন্যরকম আশার দিক নির্দেশিকা হিসেবে হয়েছিল এদেশের জনগণের কাছে, সৈনিকদের কাছে। এই সত্য অস্বীকারের সুযোগ রয়েছে কি?

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

/এসবি/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়