ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১৯ ১৪৩১

একটি নাম ‘বিভ্রাট’ নিয়ে এত আলাপ কেন?

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ১৪ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১০:৫৮, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
একটি নাম ‘বিভ্রাট’ নিয়ে এত আলাপ কেন?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরা সিএনজি স্টেশনের সামেন গুলিবিদ্ধ হন সোহান শাহ। ৩৯ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি (ফাইল ফটো)

ভারগো গার্মেন্টস কোম্পানীর ‘এক্সিকিউটিভ ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ মো. সোহান শাহ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরা সিএনজি স্টেশনের সামেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৩৯ দিন পর মারা যান ৩০ বছরের এই যুবক।

এই ঘটনায় সোহানের মা ১৯ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫৭ জনের নামে আদালতে মামলা করেন। আদালত অভিযোগটি রামপুরা থানা পুলিশকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী সরকারের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা করা হয়েছে। তবে হঠাৎ সোহান হত্যা মামলাটিই কেন আলাপে উঠে এলো?
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হয়, তার আকার বেড়েছে; এখন ২১ উপদেষ্টা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। 

১০ নভেম্বর তিন উপদেষ্টা শপথ নেন। এই তিন উপদেষ্টার মধ্যে রয়েছেন শিল্পগোষ্ঠী আকিজ-বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন। তার শপথ গ্রহণের পর মামলার আসামির তালিকার নাম-সংক্রান্ত বিষয়টি আলাপে আসে।

সোহান হত্যা মামলায় এজাহারের ৪৯ নম্বর আসামি হিসেবে নাম আসে শেখ বশির উদ্দিন ভূইয়ার। তার পরিচয়ে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা। ঠিক তার আগের নামটি অর্থাৎ ৪৮ নম্বর আসামি করা হয়েছে যশোর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন ভূইয়াকে। দুই জনের পিতার নাম দেওয়া হয়েছে শেখ আকিজ উদ্দিন ভূইয়া। তাদের দুজনের ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে একই। 

উপদেষ্টা বশির উদ্দিনের ভাই হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আফিল উদ্দিন। সে ক্ষেত্রে সোহান হত্যা মামলার আসামি নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে ভূইয়া শব্দটা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা, যা নিরসনে কাজ করছে রামপুরা থানা পুলিশ। শেখ বশির উদ্দিন ভূইয়ার পরিচয় খুঁজে দেখছে পুলিশ।

এ সম্পর্কে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রামপুরা থানার উপ-পরিদর্শক একরামুল হক বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। এজাহারের আসামি শেখ বশির উদ্দিন ভূইয়া অন্তবর্তী সরকারের নতুন উপদেষ্টা কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। মামলার তদন্ত এখনও শেষ করতে পারিনি। নতুন উপদেষ্টার সঙ্গে নাম প্রায় সেম টু সেম। যাচাই-বাছাই করছি- নতুন উপদেষ্টা কি না।’

নতুন উপদেষ্টা আসামি হলে পরবর্তী করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা সিনিয়ররা দেখছেন। তারাই বলবেন।’ 

বাদীপক্ষের আইনজীবী ইলতুৎমিশ সওদাগর বলেন, ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া নতুন উপদেষ্টা কি না, ক্লিয়ার করতে পারব না। একজন লইয়ার হিসেবে ভিকটিমের পরিবার আমাদের কাছে আসে। ভিকটিম কীভাবে মারা গেছে জানায়। কে কে সম্পৃক্ত থাকে ব্রিফ করে। এরপর আমরা তাদের দেওয়া তথ্য মতে বক্তব্য ও লেখা ঠিক করি। উনি উপদেষ্টা বশির নাকি অন্য বশির বলতে পারব না।’

যোগাযোগ করা হলে সোহানের মামা মো. মিজানুর জানান, ‘ভাগ্নে মারা গেছে এই হিসেবে সাক্ষী হয়েছি। কার বিরুদ্ধে আমার বোন মামলা করেছে, তা জানি না।’

তিনি বলেন, ‘আমার বোন লেখাপড়া জানে না। একজন নাম দিছে। সেই নাম আসামির তালিকায় দিয়ে দিছে। কে কীভাবে দিছে জানি না। আমার বোন কাউকে চেনে না।’

মিজানুর বলেন, ‘১৯ জুলাই সোহান গুলিবিদ্ধ হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে তাকে বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইসলামিয়া হাসপাতালসহ ২০ থেকে ২২টি হাসপাতালে ঘুরছি। কেউ তাকে ভর্তি করেনি। কর্তৃপক্ষ বলে, উপরের নির্দেশ আছে।’

‘গুলিবিদ্ধ রোগী ভর্তি নেওয়া যাবে না। পা পর্যন্ত ধরেছি, তারপরও কেউ ভর্তি করেনি। পরে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে তাকে রেফার করে। পরদিন ভোরে ভর্তি নেয়। সেখানে গেলেও পুলিশ হুমকি দেয়।’

সেইদিনের ঘটনার বর্ণনায় মিজানুর যোগ করেন, ‘৬ আগস্ট চিকিৎসা শেষে তাকে বাসায় নিয়ে যাই। এরপর নতুন সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানোর কথা বলা হয়। তার পাসপোর্ট করতে যাই। কিন্তু তার নামে মাগুরার শ্রীপুর থানায় ২৪ জুলাই নাশকতার মামলা করা হয়। একারণে পাসপোর্ট করতে পারিনি।’

‘৩৯ দিন পর সোহান মারা যায়। বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করালে হয়তো ভাগ্নেটা বেঁচে যেত । আমার বোন বড় ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলল। হারাল উপার্জনের একমাত্র সন্তানকে। অনেক দুঃখ, কষ্ট তার। ছেলেকে হারিয়ে সে পাগল হয়ে গেছে। কীভাবে, কী মামলা হলো; সেও ভালো জানে না।’ 

এ বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় সোহানের মা সুফিয়া বেগমের সঙ্গে। তবে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে তার বক্তব্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। সেখানে সুফিয়া বেগম বলেন, ‘সন্তান হারিয়ে আমি প্রায় পাগল অবস্থায় রয়েছি। এমন সময়ে মোবাইল করে আমাকে ঢাকায় আদালতে যেতে বললে আমার স্বামী সেকেন্দার শাহের সঙ্গে গিয়েছিলাম। ঢাকায় যাওয়ার পর স্বাক্ষর করেছি কিন্তু ওই মামলায় কারা আসামি, কাদের নাম লেখা আছে; সেটি জানা নেই। 

‘তবে মামলা যারাই করুক, আমি স্বাক্ষর করেছি। মামলায় যাদের নামই থাকুক, আমি ন্যায়বিচার চাই। চাই আর কোনো মা যেন অকালে সন্তান না হারায়।’

মামলার বিষয়টি নিয়ে সোমবার (১১ নভেম্বর) সচিবালয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘আমি খুব ভালো জানি না। আমাদের লিগ্যাল টিম বিষয়টি দেখছে। ওখানে (মামলার এজাহার) আমার নামের, আবার বাবার নামের কিছু সংগতি আছে, কিছু অসংগতি আছে। এটা আসলেই আমি কি না, আমি নিশ্চিত নই। নিশ্চিত হলে লিগ্যালি ফেস (আইনিভাবে মোকাবিলা) করা হবে।’

মামলার উল্লেখযোগ্য অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার বিশ্বাস, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, নরসিংদী-১ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হিরু, নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার আশরাফ খান দিলীপ, মাইনুল হোসেন খান নিখিল, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন, শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস-২ সাইফুজ্জামান শিখর।

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরা থানাধীন সিএনজি স্টেশনের সামনে গুলিতে আহত হন মো. সোহান শাহ (৩০)। এরপর গত ২৮ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সোহান।

ঢাকা/মামুন


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়