ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

ভাসমান সবজি চাষে লাভবান কৃষক

মুহাম্মাদ তাওহিদুল ইসলাম, পিরোজপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:২৯, ১৬ নভেম্বর ২০২৪  
ভাসমান সবজি চাষে লাভবান কৃষক

পিরোজপুরের নাজিরপুরে বিলাঞ্চলের প্রায় ৮০-৯০ ভাগ মানুষ ভাসমান সবজি চাষের সাথে জড়িত। বৈশাখ থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত এই ভাসমান সবজির চাষ চলে।

পূর্বপুরুষের কাছ থেকে দেখে শিখেছেন ভাসমান চাষ পদ্ধতি, বলছিলেন পিরোজপুরের নাজিরপুরের মুগারঝোরের কৃষক ইব্রাহীম। তার বাবা-দাদারা এই চাষাবাদ করে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনিও ছোটবেলা থেকে এই চাষাবাদের সাথে জড়িত। ইব্রাহীমের মতো পিরোজপুরের নাজিরপুরে বিলাঞ্চলের প্রায় ৮০-৯০ ভাগ মানুষ ভাসমান সবজি চাষের সাথে জড়িত। বৈশাখ থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত এই ভাসমান সবজির চাষ চলে। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরে অন্যান্য ফসল চাষ হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলার কিছু এলাকা সারা বছরই জোয়ার-ভাটার কারণে জলাবদ্ধ থাকে। যার আয়তনের পরিমাণ প্রায় ২৮০ হেক্টর।

ভৌগলিকভাবে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী-দোবড়া, কলারদোয়ানিয়া ও মালিখালী পিরোজপুরের নাজিরপুরের দেউলবাড়ি দোবড়া, কলারদোনিয়া, মালিখালী এই তিন ইউনিয়নের কলারদোয়ানিয়া, মুগারঝোর, পদ্মডুবি, মনোহরপুর, দেউলবাড়ী, সোনাপুর, বিলডুমরিয়া নিয়ে গঠিত নাজিরপুরে বিলাঞ্চল।

এ ছাড়া নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের গগন, চামি, ডুবি ও বিন্না এলাকায় নিম্নাঞ্চল নামে পরিচিত। এসব এলাকা সারা বছর ৫-৮ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। তবে বর্ষা মৌসুমে তা বেড়ে ১০ থেকে ১২ ফুট হয়ে থাকে। আর এ কারণে এ অঞ্চলে প্রায় ২৫০ বছর আগে উদ্ভাবন হয় বিরল ভাসমান চাষ পদ্ধতি। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে এলাকার কয়েক হাজার কৃষকের।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা এশা বলছেন, ‘‘নাজিরপুরেই সর্বপ্রথম ভাসমান চাষাবাদ শুরু হয়। তখন এই নিম্নাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে মানুষের কোনও কাজ ছিল না। শ্রমের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জলজ আগাছা, কচুরিপানা, শ্যাওলা ও দুলালী লতা দিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করা হতো। ধীরে ধীরে এর বিস্তৃতি ঘটেছে। তবে ভাসমান চাষ পদ্ধতি আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পেয়েছে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের ভাসমান সবজি চাষকে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।’’

পিরোজপুর জেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে ক্ষতি হচ্ছে সেটি মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে ত্রাতা হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে ভাসমান ধাপের ওপর বিভিন্ন সবজির চারা শাক-সবজি ও মসলার আবাদ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসও এ পদ্ধতির চাষাবাদে তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারে না। এছাড়া এখানকার উৎপাদিত চারা পাশের দেশেও রপ্তানি করা হয়ে থাকে।’’

মুগারঝোরে ভাসমান সবজি চাষি কামরুজ্জামান বলেন, ‘‘এই এলাকার অধিকাংশ চাষির তেমন নিজস্ব জমি নেই। যেসব চাষিদের নিজস্ব জমি নেই তারা সাধারণত অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ভাসমান সবজি চাষের উপযোগী ভাসমান বেড ক্রয় করে করে সবজি চাষ করে থাকেন। আর যাদের জমি আছে, তারা সাধারণ ভাসমান বেড ক্রয় করে চাষাবাদ করে থাকেন। বর্ষার মৌসুম শুরুর সাথে সাথে এ এলাকার শ্রমিকেরা ভাসমান বেড তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। সাধারণত পাঁচ ফুট উঁচু ও চার ফুট প্রস্থ করে ৪০-৫০ ফুট লম্বা ভাসমান বেড তৈরি করা। তবে কখনো কখনো এটি ৭০- থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত লম্বা করে থাকে। ৪০-৫০ ফুট লম্বা একটি ভাসমান বেড ৭ থেকে ৮ হাজার আর ৭০ থেকে ৮০ ফুট লম্বা ভাসমান বেড ১০-১২ হাজার টাকায় ক্রয় করা যায়। চারজন লোক দুই দিনে একটি ধাপ তৈরি করতে পারেন।’’

ভাসমান বেড কী

কৃষিসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে সবজি উৎপাদনের এটি একটি বিশেষ কৌশল। ভাসমান এ পদ্ধতিকে স্থানীয় ভাষায় বলে ধাপ পদ্ধতি বা বেড় পদ্ধতি। সাধারণ জলজ আগাছা কচুরিপানা, খুদিপানা, টোপা পানা, শ্যাওলা দুলালী লতা ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে খড়কুটা এবং নারিকেলের ছোবড়াগুড়া মিলিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে তৈরি করা হয় ভাসমান বীজতলা বা ধাপ। কয়েকদিন পর ধাপটি নরম হলে তার ওপর দৌল্লা বসানো হয়।

বল বা দৌল্লা বানানোর পদ্ধতি

টোপাপানা দুলালী লতা দিয়ে প্যাঁচিয়ে ছোট বল আকৃতির মতো তৈরি করেন কৃষকরা। দলা দলা করে বানানো হয় বলে এগুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘ট্যামা’ বা ‘দৌল্লা’ বলা হয়। বলের মাঝখানে অঙ্কুরোদগম বীজ বসিয়ে ছায়ায় রাখা হয়। বীজ ভিজিয়ে রাখলে পাঁচ থেকে সাত দিনে অঙ্কুরোদগম হয়। পাতা বের হওয়ার পর দৌল্লাগুলো ধাপের ওপর রাখা হয়। কৃষক পরিবারের নারীরা ও ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়িতে বসে চারা তৈরির বল বা দৌল্লা তৈরি করে থাকে।

দাদনে সবজি চাষ

কৃষকদের নিজস্ব জমি না থাকায় ফসল চাষাবাদের জন্য ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পায় না। তাই স্থানীয় মহাজনদের কাছে থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ফসল আবাদ করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাভের মুখ দেখতে পারেন না। তাছাড়া উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিদের লাভের পরিমাণ কমে গেছে। তাই স্থানীয় কৃষকদের দাবি, কম সুদে সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের (রিক) কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিচালক আবুল হাসিব খান জানান, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতায় মূলত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের কারিগরি সহায়তাসহ মাসিক, ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক কিস্তিতে ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। প্রান্তিক, ভূমিহীন, বর্গা চাষি, কৃষকদের ব্যাংক ঋণ না দেওয়ায় আমরা তাদের ১৯ শতাংশ হারে কোনও জামানত বা শর্ত ছাড়া ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকি। আমাদের এই ঋণ নিয়ে তারা অনেক ভালো আছেন। আমরা ঋণ না দিলে তাদের এই ঋণটা নিতে হয় মহাজনদের কাছ চড়া সুদে।

দেশের প্রথম কৃষি ঐতিহ্য স্থাপনা 

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২৫০ বছর আগে এ অঞ্চলে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু হলেও ১৯৮০ সালের দিকে এর ব্যাপকতা লাভ করে। আর তাই জলাবদ্ধতা আর কচুরিপানার অভিশাপকে এ অঞ্চলের কৃষকদের অভিনব কৌশলকে কৃষি ঐতিহ্য সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশের ভাসমান সবজি চাষকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ভাসমান আবাদকে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর গ্লোবাল অ্যাগ্রিকালচার হেরিটেজ সিস্টেম সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা এশা বলেন, ‘‘ভাসমান পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব ও জৈব পদ্ধতিতে এ ফসল আবাদ করা হয়। চাষের খরচ তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সেচের প্রয়োজন পড়ে না। খুব কম সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা যায়। সাধারণত বর্ষার প্রথম সপ্তাহ থেকে ভাসমান সবজি চাষের কাজ শুরু হয়ে যায়। এ সময় আমরা নতুন-পুরাতন সব চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। যাতে করে সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি প্রয়োগ করে ভাল ফলন পেতে পারেন।’’

ঢাকা/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়