ঢাকা     শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১২ ১৪৩১

‘কুকুর নয়, আমি আসলে মানুষ নিয়ে ভাবছি’

ড: ফারজানা আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ২৩ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৩:৩২, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
‘কুকুর নয়, আমি আসলে মানুষ নিয়ে ভাবছি’

সম্প্রতি ছয়টি কুকুর এবং একটি বিড়ালকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে ঢাকার একটি ‘প্রায়’ অভিজাত এলাকার লোকজন। মেরে ফেলা তো কোনো আনন্দের কাজ নয়। তাহলে মারলো কেন? হয়তো এলাকার অধিবাসীদের কষ্ট হচ্ছিল, পশুগুলো এলাকা নোংরা করছিল, কিংবা রাতবিরাতে চেঁচামেচি করছিল, নয়তো নিজেরা নিজেরাই মারামারি করে অশান্তি সৃষ্টি করছিল। ধরে নিচ্ছি মেরে ফেলার যথেষ্ট কারণ আছে। এই পরিস্থিতিতে আমি এর প্রতিবাদ লিখতে বসিনি। কুকুর নয়, আমি আসলে মানুষ নিয়ে ভাবছি। 

পরিবেশ পরিস্থিতি কী সবসময় আমাদের অনুকুলে থাকে? প্রতিদিন কতো মানুষকে বাইরে কোথাও যেতে হচ্ছে। যেতে যেতে দেখা যায় পাশ দিয়ে সাঁই করে বিরাট গাড়ি পানি ছিটিয়ে দিয়ে চলে যায়। ওই ময়লা জামা পড়েই অফিস করতে হয়, গাড়ির কিছুই করতে পারি না আমরা। বাড়িওয়ালা অনেক সময় পানি ছাড়েন না— এতেও আমাদের কষ্ট হয় কিন্তু সহ্য করে নেই। কারণ প্রতিবাদের সামর্থ্য নেই। আমরা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনের গন্ধও সহ্য করে নেই।

বিভিন্ন ঋতুতে নতুন নতুন অসুখ বিসুখ চলে আসে, কাকে দোষারোপ করবো! ভুগি এবং মেনে নেই। বাড়িতে শিশুরা থাকে, তারা কোন নিয়ম মেনে চলে না। যখন ইচ্ছা হাসে কাঁদে, রাত জেগে চেঁচায়, কাউকে ঘুমাতে দেয় না। কতো কষ্ট করে আমরা শিশু পালন করি। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে অনেক এডজাস্ট করতে হয়, ছাড় দিতে হয়। ছাড় আমরা নিজেরাও নেই। বাড়িতে শিশু ছাড়া বৃদ্ধরাও থাকেন। তাদের ও ঘুম কমে যায়, রাত জাগেন, কাশেন, কথা বলেন, কতো কি! মানুষ শিশু হয়ে জন্মায় বৃদ্ধ হয়ে মারা যায়। এরমাঝে জীবনের নানান পর্যায়ে নানান রকম কম্প্রমাইস করেই আমরা বেঁচে থাকি। সবলের সাথে পারিনা বলে কম্প্রমাইস করি, প্রিয়জনদের মমতার কারনে কম্প্রমাইস করি। পথের কুকুর বিড়ালের মতো দুর্বল ভাষাহীন নোংরা নাপাকের বেলায় এতো ঝামেলা না করে খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেল্লেই ল্যাঠা চুকে যায়। মেরে ফেলায় তো কোন কষ্ট নেই, ওরা সবসময় ক্ষুধার্ত, তার ওপর মানুষকে ভীষণ বিশ্বাস করে। সামান্য খাবার দিলেই বিরাট বন্ধু মনে করে লেজ নাড়তে থাকে। সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে খাবারে বিষ মিশিয়ে দিলেই  হয়! কতো আর দাম বিষের!! জীবনের মতো ঝামেলা শেষ! 

আমি কেবল ভাবছি- যে শিশুরা দেখলো, কুকুর বিড়াল অশান্তি করলেই বিষ দিয়ে মেরে ফেলে শান্তিতে ঘুমিয়ে যায়, তাদের ঘরের নানি, দাদি কিংবা বাবা মা বৃদ্ধরা যখন অসুখে কাতরাবেন, রাতের ঘুম নষ্ট হবে, তখন তারা ধৈর্য ধরতে পারবেন তো? নাকি সর্টকার্ট বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাববেন? অসুস্থদের যত্ন নেওয়ার ঝক্কিটুকু নেবার অভ্যাস তাদের হবে তো? আপনজনদের প্রতি তারা দিনশেষে কতটুকু হৃদয়বান থাকবেন? তাদের কাছে অসহায় মানুষেরা কতটুকু নিরাপদ? 

নিষ্ঠুরতা প্রকাশের শুরু সবসময় দুর্বলকে দিয়েই শুরু হয়। সমাজে সবচে দুর্বল হলো পথের বেওয়ারিশ প্রাণী। তারপর শিশু, তারপর নারী এবং বৃদ্ধ। শিশু নির্যাতন কিংবা নারী নির্যাতন একদিনে শেখা যায় না।মাকে মেরে টুকরো করে ফ্রিজে ভরে রাখা সহজ কাজ নয়। মনের গভীরে এই মানসিকতার বীজ ছোটবেলা থেকে বুনে দেওয়া হয়, ধীরে ধীরে নিজেদের অজান্তেই আমরা নিষ্ঠুর হয়ে যাই। যখন নৃশংস ঘটনাটি ঘটে যায়, আমরা আতকে উঠি। You start by killing a bird and you will end up by killing a man. পৃথিবীটা স্রষ্টা শুধুমাত্র আমাদের একার জন্য তৈরি করেন নি। এখানে সবার অধিকার আছে। আজ আমি শক্ত মানুষ, কুকুর মেরে শান্তিতে ঘুম দিলাম, কাল আমি অসুস্থ অসহায় হয়ে কারও অশান্তির কারণ হলে তারা আমার প্রতি সহৃদয় হবে তো? পৃথিবীর সকল প্রাণীরই কোন না কোন পর্যায়ে করুণা প্রয়োজন হয়। 

ঢাকা/লিপি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়