‘দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি মুক্ত হয়ে বাংলা একাডেমির উচিত সর্বজনের হয়ে ওঠা’
সুশীল মালাকার || রাইজিংবিডি.কম
মোহাম্মদ আজম প্রাবন্ধিক ও গবেষক। আগ্রহের বিষয় সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব, ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন। শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। অনুবাদ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু তাত্ত্বিক রচনা। বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলা একাডেমি নিয়ে তার পরিকল্পনা, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কার, আসন্ন অমর একুশে বইমেলাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন রাইজিংবিডির সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুশীল মালাকার
রাইজিংবিডি: বাংলা একাডেমির পথচলা বহু বছরের। প্রতিষ্ঠানটি গঠনের যে উদ্দেশ্য ছিল সেটি পূরণে বাংলা একাডেমি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
মোহাম্মদ আজম: বাংলা একাডেমির ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখব যে- এর সাফল্য বেশ ভালোই। তার একটা প্রমাণ এই যে, বাংলা একাডেমির ব্যাপারে মানুষের খুবই কেন্দ্রীভূত আগ্রহ রয়েছে। এই আগ্রহটা আসলে একাডেমির ইতিহাস থেকে এবং ঐতিহাসিক সাফল্য থেকে তৈরি হয়েছে। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নাই যে, বিগত দশকগুলোতে সেই সাফল্যের মাত্রা খানিকটা কমেছে। সামগ্রিকভাবে বাংলা একাডেমির যে সক্ষমতা এবং অবদান রাখার যে সুযোগ এখনো যথেষ্ঠ আছে বলে আমি মনে করি, রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেসব সমস্যা হয়েছে সেগুলো দূর করার সুযোগ আছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলা একাডেমির যে সুনাম এবং সমৃদ্ধি তা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
রাইজিংবিডি: দায়িত্ব গ্রহণ করার পর কাজ করতে গিয়ে বাংলা একাডেমির ঠিক কোথায় ঘাটতি আছে বলে আপনার মনে হচ্ছে?
মোহাম্মদ আজম: বাংলা একাডেমির স্বাভাবিক এবং সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এর কাঠামোগত ভিত্তি এখনো যথেষ্ঠ ভালো আছে। সমস্ত জনশক্তি যদি এই সকল কাজ করার জন্য উপযোগী বিবেচনায় নেওয়া যেত তবে এই সক্ষমতা আরো বাড়তো। সেটা আসলে পুরোপুরি সম্ভব নয়। কারণ এটা একটা সরকারি অফিস। এখানে নিয়ম এবং অপরাপর বিধি মান্য করতে হয়। এতে বিভিন্ন সময়ে কিছু ব্যত্যয়ও ঘটেছে। তারপরও আমি বলব যে, কাজ করার এই সক্ষমতা এখনো যথেষ্ঠ আছে।
আসলে বাংলা একাডেমির খ্যাতির কারণেই একে রাষ্ট্রীয় ভার বহন করতে হয়। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় অভিব্যক্তি প্রকাশের ভার বহন করতে হয়। রাষ্ট্র তো আমাদের দেশে সমস্ত মানুষকে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার মতো সক্ষম হয়ে ওঠেনি। ফলে রাষ্ট্র অনেক সময় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি একাডেমির উপর চাপিয়েছে। আবার এর সঙ্গে যদি দল যুক্ত হয়, তাহলে ব্যাপারটা আরো গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে যায়। এরকম সীমাবদ্ধতা বাংলা একাডেমির ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছে।
আরেকটি সীমাবদ্ধতা ঠিক বাংলা একাডেমির ব্যাপার নয়। একটা জনসমাজে জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমানে প্রস্তুত মানুষ থাকেন। তাদের মধ্যে যদি দলীয় বিবেচনায় বা মতাদর্শিক বিবেচনায় যদিও বাছাই করা হয় তাহলেও তাদের যোগ্যতার ঘাটতি হয় না। এ ধরনের প্রস্তুত মানুষ যথেষ্ঠ পরিমান কম এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো অনেক কমে গেছে। এটা আমি এখনকার সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি। গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট কাজ করার জন্য যে পরিমানে প্রস্তুত মানুষ সমাজে থাকতে হয় সেরকম মানুষ হয়তো সমাজে নাই। কাজগুলো তো বাংলা একাডেমি আর নিজে করবে না। সে ব্যবস্থাপনা করবে, উদ্যোগ নেবে, আয়োজন করবে। তাকে তো সবসময় বাইরে থেকে পণ্ডিত ধার করতে হবে। সেটার একটা ঘাটতি আছে। এটাকেই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি।
রাইজিংবিডি: আপনি ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নিয়েছেন। একাডেমি সংস্কারে কথা বলছেন অনেকে। বাংলা একাডেমি নিয়ে আপনি কী ভাবছেন? আপনার পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি।
মোহাম্মদ আজম: প্রাথমিকভাবে এটা শুধু আমার একার ব্যাপার নয়। একাডেমিতে যারা সিনিয়র এবং যোগ্য লোক রয়েছেন তাদের ব্যাপার। একইসঙ্গে এটা সরকার এবং মন্ত্রণালয়েরও ব্যাপার। সেদিক থেকে আপাতত আমি কোনো সংকট বোধ করছি না। আমার প্রথম লক্ষ্য একাডেমির যে স্বাভাবিক সক্ষমতা এবং স্বাভাবিক কাজ, সেই ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা করা। আমার বিবেচনায় এটা প্রতিষ্ঠা করা গেলেই বাংলা একাডেমির যে উৎপাদনশীলতা এটা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু এর বাইরেও আরো কিছু ব্যাপার আছে, সে ব্যাপারগুলো হলো- একাডেমি তার প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান এবং সক্ষমতার কারণে এমন কিছু কাজ করতে পারে যেটা অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা তার দায়িত্বও বটে। যেমন ভাষার প্রমিতায়ন, ব্যাকরণের প্রমিতায়ন, উৎকৃষ্ট অভিধান প্রণয়ন করা, কোষগ্রন্থ প্রণয়ন করা, যে গবেষণা গ্রন্থগুলো অন্য সাধারণ প্রকাশকরা ব্যবসায়িক ঝুঁকির কারণে ছাপার ঝুঁকি নেবে না সেগুলো ছাপার বন্দবস্ত করা। যে সমস্ত সেবা ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে লোকে চায়; সমাজে চাহিদা আছে অথচ তা দেওয়ার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে নাই; অন্য প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সাহিত্যপত্রিকা- এদের পক্ষে যেটা করা সম্ভব নয়, সেটা বাংলা একাডেমি করতে পারে। সে ধরনের কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা আমার এখনকার লক্ষ্য।
রাইজিংবিডি: বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ সালগুলো বাংলা একাডেমির কাজগুলোকে প্রভাবিত করেছে এবং সংস্কারও হয়েছিল। ২০২৪ সাল একাডেমির কাজকে কীভাবে প্রভাবিত করবে?
মোহাম্মদ আজম: আমার ধারণা, প্রধান প্রভাবটি ঘটা উচিত এই যে, খুবই সংকীর্ণ এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা একাডেমিতে যেভাবে জেঁকে বসেছিল সেটা থেকে মুক্ত হওয়া। মুক্ত হয়ে এটা যথাসম্ভব সর্বজনের হয়ে ওঠা। এই আকাঙ্খা যদি বাংলা একাডেমি পরিপূরণ করতে পারে তাহলে আমি মনে করি গভীরতর অর্থে এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের অর্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। এর বাইরে প্রত্যক্ষভাবে একাডেমি এমন ব্যবস্থা করতে পারে যেখানে যে কাজগুলো আকাঙ্খিত ছিল কিন্তু নানান কারণে হয় নাই সেগুলোর উদ্যোগ আয়োজন করা। একদম প্রত্যক্ষভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কিত যদি ভালো বই-পুস্তক পাওয়া যায় সেগুলো ছাপানোর বন্দবস্ত করা। যদি এই উপলক্ষে নব উপলব্ধ বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য এগুলো সম্পর্কিত কোনো প্রস্তাব আমাদের কেউ দেয় তাহলে সেগুলো গ্রহণ করার বাস্তবতা পরীক্ষা করে দেখা এবং নিজেরাও কিছু উদ্যোগ নেওয়া।
রাইজিংবিডি: ২০২৪ সালকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে ১৯৭১ সালকে আড়ালে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কিনা? আপনি কি মনে করেন?
মোহাম্মদ আজম: এটার প্রবণতা আমাদের জনসমাজের কোনো কোনো অংশের নেই তা নয়। কিন্তু আমার ধারণা যাদের আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে নির্ভরযোগ্য মনে করি তাদের ভিতরে আমি খুব একটা দেখিনি। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, একাত্তর নিজে একটা অস্তিত্ব কিন্তু একাত্তর যেভাবে দলীয় ও গোষ্ঠীগতভাবে ব্যবহৃত হয় সেটা আরেকটা অস্তিত্ব। এই দুই অস্তিত্বকে একাকার করে ফেলা মোটেই উচিত হবে না। যদি কখনো দেখা যায় ওই দলীয় ও গোষ্ঠীগত চর্চার সংকীর্ণ যে একাত্তর, সেই একাত্তরকে যদি কেউ মোকাবিলা করতে চায় তাহলে সে ওই একাত্তরকেই মোকাবিলা করছে এরকম ভাবনাটাও কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে ও তাত্ত্বিকভাবে দূষণীয়। ফলে এই কথাটা আমাদের বুঝতে হবে, একাত্তরের যে দলীয় ভার্সন সেটার সমালোচনা হতে পারে। এটা কিন্তু একাত্তরকে নাকচ করা নয়। এই প্রত্যেকটা দিক ভেবে আমাদের এই সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নাই যে, সমাজের কোনো কোনো অংশের এই ধরনের কথাবার্তার একটা প্রবণতা আছে।
রাইজিংবিডি: কিছুদিন আগে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে একটি কমিটি গঠন করা হলো। যে কমিটিতে আপনিও ছিলেন। কিন্তু একটি গোষ্ঠীর দাবির মুখে হঠাৎ কমিটি বাতিল করা হলো। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ আজম: এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণরূপে মতামত দিতে পারব না। তার কারণ কমিটি গঠন এবং বাতিলের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি পুরোপুরি জানি না। দুটি কথা এখানে বলে রাখা দরকার, এটা বোধয় পরিষ্কার করে বলা হয় নাই এবং লোকে খুবই কম জানে যে, ওই কমিটি ছিলো খুব দ্রুততার সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের যে প্রয়োজনিয়তা দেখা দিয়েছিল সেই কাজটা করার জন্য। এটা আসলে শিক্ষানীতি করা, কারিকুলাম করা কিংবা বড় ধরনের কাজ করার জন্য কিন্তু ওই কমিটি করা হয় নাই। আদতে যখন এই কমিটি গঠিত হয়েছে এবং বাতিল হয়েছে তার আগেই কিন্তু এই প্রাথমিক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজগুলো শেষ পর্যায়ে ছিল। সুতরাং এই তথ্যটা যে ভঙ্গিতে প্রচারিত হয়েছে আসলে সেটা সেই ভঙ্গিতে প্রচারিত হওয়ার মতো বিষয় না। তবে আমি বিষয়টা না বলে পারছি না যে, বিশেষভাবে কোনো কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে নানান ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা এবং তাকে সকল ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার দাবির যে একটা প্রবনতা সমাজে দেখতে পাচ্ছি, আমি সেটাকে কোনো দিক থেকে কারো জন্যই সমর্থনযোগ্য মনে করি না।
রাইজিংবিডি: বিগত বছরগুলোতে একুশে বইমেলায় কোন অসঙ্গতিগুলো আপনার চোখে বেশি পড়েছে?
মোহাম্মদ আজম: গত বছরের বইমেলাটা আমি একটু কম পছন্দ করেছি। কারণ গতবছর জায়গার দিক থেকে কিছুটা সংকীর্ণ ছিল। এর বাইরে গত পাঁচ-সাত বছরের বইমেলার কোনো কোনো বিষয় আমি দারুণভাবে উপভোগ করেছি! আমি বইমেলার নিয়মিত একজন যাতায়াতকারী সদস্য। আমার কাছে ব্যাপারগুলো আনন্দদায়কই ছিল। বিভিন্ন পক্ষ থেকে যে অভিযোগ উঠেছিল হয়তো এগুলো অনেকদূর পর্যন্ত ঠিক। কিন্তু একটি বড় আয়োজনে সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট করা হয়তো কারো পক্ষেই সম্ভব না। কোনো কোনো ব্যাপারে হয়তো আরো সতর্ক হওয়া যেত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে গত বছরের একটু সংকীর্ণ পরিসরের ব্যাপারটা বাদ দিলে গত কয়েক বছরের বইমেলা আমার কাছে মোটামুটি ভালোই মনে হয়েছে।
রাইজিংবিডি: আমাদের বইমেলাকে আন্তর্জাতিক মানের বইমেলায় রূপদানের জন্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ আজম: আমার কাছে মনে হয় বিদ্যমান বই এবং ভাষা চর্চার যে অবস্থা এখানের ‘আন্তর্জাতিক মান’ কথাটা একটা মুখরোচক বুলি মাত্র। আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আমাদের বাস্তবতাটা এমনকি কলকাতার চেয়েও বিপুলভাবে আলাদা। ভারত চল্লিশটি ভাষার দেশ এবং ভারতের প্রকাশনা সংস্থা যদি আমরা হিসাব করি তাহলে আমরা দেখব সেখানে সারা পৃথিবীর প্রধান প্রকাশনাগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিরই সেন্টার আছে। এর সঙ্গে বাজারের ব্যাপারটা যুক্ত, এর সঙ্গে ভাড়ার ব্যাপারটি যুক্ত। এর কোনো ধরনের বাস্তবতাই বাংলাদেশে নেই। যারা আন্তর্জাতিক বইমেলার কথাটা উচ্চারণ করেন আমি জানি যে, তারা অনেকে খুবই অভিজ্ঞ কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতার ব্যাপারটা তারা সম্পূর্ণ মাথায় রাখেন বলে আমার মনে হয় না। তবে নিশ্চয়ই আমাদের একটু উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। সেই উন্নতিটি হলো প্রকাশনার ব্যাপারে অধিকতর নির্ভরযোগ্য হওয়া। কোনো কোনো বইয়ের অন্য ভাষায় রূপান্তর এবং অন্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় রূপান্তরের ব্যাপারগুলো বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিক বাস্তবতা তৈরি করা। এসব ব্যাপারে নিঃসন্দেহে উন্নতির সুযোগ রয়েছে।
তারা//