উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন নিভল নিজ ক্যাম্পাসেই
আফসানা করিম রাচি
আফসানা করিম রাচি মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পেয়েছিলেন জিপিএ-৫। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও পেয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু, তা আর হলো না। তার আগেই নিভে গেল জীবনপ্রদীপ।
গত ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাস্তা পার হওয়ার সময় অটোরিকশার ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রাচি। এ ঘটনায় পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আবু সৈয়দ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন।
রাচির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। রাচির ঘাতককে গ্রেপ্তারের দাবি জানান তারা।
গত ২৪ নভেম্বর রাতে আশুলিয়া থানাধীন গেরুয়া এলাকা থেকে অটোরিকশার চালক আরজু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন আদালত তার এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ২৭ নভেম্বর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলার তদন্ত চলছে। আগামী ৬ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য রয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক অলক কুমার দে বলেছেন,“রাস্তাটা ফাঁকা ছিল। রিকশার ব্রেক ঠিক ছিল না। রাস্তাটা ছিল ঢালু। মেয়েটা রাতের বেলা হেঁটে যাচ্ছিল। তার কানে হেডফোনও ছিল। দুজনের কেউই বিষয়টা নোটিশ করেননি। যখন খেয়াল করেছে, ততক্ষণে অনেক লেট হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “মামলার তদন্ত চলছে। আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।”
মামলার বাদী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আবু সৈয়দ বলেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের অনুমোদন সাপেক্ষে মামলা করেছি। রিকশাচালকের কারণে নাকি শিক্ষার্থীর অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা তদন্তে জানা যাবে।”
আফসানা করিম রাচির বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চর বড়ইগাছি গ্রামে। তার বাবা সড়ক ও জনপথ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী রেজাউল করিম বাদল। রেজাউলের তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে রাচি পঞ্চম। মেয়েদের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। রাচির মেজ বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। আর বড় বোন রসায়ন শাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন। তারা তিন বোনই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী।
আফসানা করিম রাচি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মার্কেটিং বিভাগের ৫৩ ব্যাচের (২০২৩-২৪ সেশন) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং বেগম খালেদা জিয়া আবাসিক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন।
রাচির বাবা রেজাউল করিম বলেছেন,“আমার মেয়েটা যথেষ্ট মেধাবী ছিল। ভিকারুননিসা নূন স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছে। আমার তিন মেয়েই সেখানে পড়েছে। রাচি এসএসসি, এইচএসসিতে গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছে। পরে তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো। ওর আশা ছিল, স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবে। আমি চেয়েছিলাম, পড়াশোনাটা ভালোভাবে শেষ করুক। তা আর হলো না।”
তিনি বলেন,“দুর্ঘটনা ঘটে ১৯ নভেম্বর মঙ্গলবার। ও ঢাকার বাসায় ছিল রোববার ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত। ক্যাম্পাসে হ্যান্ডবল কম্পিটিশন ছিল। রোববার আমাকে বলে যে, ক্যাম্পাসে যাব। ওর মা ছেলের কাছে মালয়েশিয়া গিয়েছিল। আমি গ্রামের বাড়িতে যাব। ওকেও সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, ও রাজি হয়নি। ক্যাম্পাসে যাবে বলে জানায়। ওর ফুফু তখন বাসায় ছিল। সেও যেতে নিষেধ করেছিল। নিষেধ না শুনে রাচি ক্যাম্পাসে যায়। সোমবারও আমার সাথে কথা হয়। খাওয়ার জন্য টাকা চায়। আমি বলি, চলে আসো, মা। সে নাকি বাসায় ফেরার জন্য ক্যাম্পাসের বাসেও উঠেছিল। কিন্তু, আবার নেমে যায়। আমাদের কথা শুনে যদি সেদিন মেয়েটা ক্যাম্পাসে না যেত। আর বাসায় ফিরে আসার জন্য বাসে ওঠার পর যদি নেমে না যেত, তাহলে হয়ত এ ঘটনাটা ঘটত না। আর তাকে হারাতে হতো না।”
দুর্ঘটনার বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন,“১৯ তারিখ দুপুরে আমি ময়মনসিংহে যাই। মাত্র বাসায় এসে ঢুকেছি, তখনই ফোন আসে, রাচি এনাম মেডিক্যালে ভর্তি। গাড়ি নিয়ে রওনা দেই সাথে সাথে। কিন্তু, মেয়েটাকে আর জীবিত দেখতে পেলাম না। সেখানে ওর শিক্ষকরা, সহপাঠীরা উপস্থিত ছিল। রিকশাটা তাকে ধাক্কা দেয়। আবার মেহগনি গাছের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়। এই ধাক্কাটা না খেলে হয়ত মেয়েটা বেঁচেও থাকতে পারত।”
আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানানো হলে বলেন, “আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। আইনের বাইরে তো কিছু করা যাবে না। আইনে যে সাজা আছে, তা-ই চাই।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী জাকির হোসেন বলেন,“একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন শিক্ষার্থী মারা গেছে। ঘটনা যে ঘটেনি, এটা বলতে পারি না। আর ঘটনা যে উনি ঘটিয়েছেন, সেটাও বলতে পারছি না। তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে জানা যাবে, কেন দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।”
গত ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটের দিকে আফসানা করিম রাচি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক (ডেইরি গেট) থেকে নতুন কলা ভবনের অভিমুখে একটি রিকশা দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল। এ সময় আরেকটি রিকশা ডেইরি গেটের দিকে দ্রুত গতিতে যাচ্ছিল। রিকশা দুটি হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ায় গতি সামলাতে না পেরে রাস্তা হেঁটে পার হওয়া রাচিকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনি গাছের ওপর আছড়ে পড়ে গুরুতর আহত হন। সেখানে উপস্থিত থাকা অন্য শিক্ষার্থীরা প্রথমে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যান। দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মুখের নিচের ম্যান্ডিবল, কয়েকটি দাঁত ভেঙে যায় এবং মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে সেখান থেকে দ্রুত ঢাকা সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক রাচিকে মৃত ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশের মাত্র এক মাসের মাথায় অনন্ত জীবনের পথে পাড়ি জমান আফসানা করিম রাচি।
ঢাকা/মামুন/রফিক