ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

ভারতীয় মিডিয়ায় গোয়েবলসের পুনর্জন্ম: নৈতিকতা নির্বাসনে

রফিক মুয়াজ্জিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৬:০৬, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪
ভারতীয় মিডিয়ায় গোয়েবলসের পুনর্জন্ম: নৈতিকতা নির্বাসনে

একটি মিথ্যা বার বার বললে তা সত্যের মতো শোনায়—নাৎসি জার্মান সরকারের তথ্যমন্ত্রী পল জোসেফ গোয়েবলসের এ তত্ত্ব বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এ কৌশল ব্যবহার করে শুরুতে বেশ সাফল্যও পেয়েছিল এডলফ হিটলারের সরকার। 

হিটলারের কুকর্মের প্রধান সহযোগী ছিলেন তার তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলস। সে সময় কিছু বুদ্ধিজীবী, কবি ও সাংবাদিকও টাকার বিনিময়ে হিটলারের পক্ষে প্রচার চালাতেন।

পল জোসেফ গোয়েবলস ভাবতেন, একই কথা বার বার বললে মানুষ তা বিশ্বাস করবে। তাই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে তিনি উচ্চ শব্দের রেডিও বসান। সেখানে দিন-রাত হিটলারের পক্ষে প্রোপাগান্ডা বাজত। তারপরও প্রচার যেন জমছিল না। গোয়েবলস তখন সস্তায় নতুন রেডিও বানিয়ে বিলি করেন। এর নাম দেন ‘পিপলস রেডিও’। সেখানে একটাই চ্যানেল। তাতে সারাক্ষণ নাৎসি সরকার ও এডলফ হিটলারের গুণগান। পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য অর্থাৎ সব প্রচারযন্ত্রে একই রকম প্রোপাগান্ডা চলে। হিটলার তো জার্মানিতে রীতিমতো মহামানবে পরিণত হন।

গোয়েবলস বলতেন, “মিথ্যা যখন বলবে, তখন বড় মিথ্যাই বলবে।” ভাগ্যিস তখন ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট ইউটিউব আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-টুইটার ছিল না। 

গোয়েবলসের অপমৃত্যু হয়েছে ৮০ বছর আগে, কিন্তু এখনও টিকে আছে তার তত্ত্ব ও কৌশল। এই অনলাইন আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে গোয়েবলসের কৌশল আরও বেশি ব্যবহার হচ্ছে। গোয়েবলস যেন পুনর্জন্ম নিয়েছেন ভারতের মোদি সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট গদি মিডিয়া হয়ে।

হিটলারের কুখ্যাত তথ্যমন্ত্রী পল জোসেফ গোয়েবলস।


ছাত্র-জনতার আন্দোলেনে গত আগস্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে পছন্দের ব্যক্তি ও দলের অধঃপতন মনঃপুত হয়নি বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের। তাই, দুই দেশের সম্পর্কে চলছে টানাপোড়েন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তো স্বাভাবিক হচ্ছেই না, বরং দিন যত যাচ্ছে, বাড়ছে উত্তেজনা। 

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, এ অভিযোগ তুলে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সহানুভূতি পেতে উঠে-পড়ে লেগেছে মোদি সরকার। অথচ, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন তুলনামূলক বেশি ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তখন কিন্তু গদি মিডিয়া তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েকদিন দলটির নেতাকর্মীদের ওপর এবং বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। যেকোনো দেশে গণঅভ্যুত্থানের পর এমন বিশৃঙ্খলা হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগে কিছু দুর্বৃত্ত বিভিন্ন স্থানে অপকর্ম করেছে। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরাও ক্ষোভ থেকে দলটির নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছেন। তখন কে হিন্দু, কে মুসলিম সেটা দেখা হয়নি। আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের ওপর প্রতিশোধপরায়নতা থেকে এসব হামলা হয়েছে বলে মনে হয়। এতে অন্যদের মতো সংখ্যালঘুদের একটি অংশও আক্রান্ত হয়েছেন, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

কিন্তু, ভারতীয় গদি মিডিয়া তিলকে তাল করে দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশে শুধু হিন্দুরাই আক্রমণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অথচ, জুলাই ও আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে নিহত হয়েছেন হৃদয় চন্দ্র, দীপ্ত দে, রুদ্র সেন, সৈকত চন্দ্র দে থেকে শুরু করে শিশু রিয়া গোপ। তারাও তো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের মৃত্যুতে কাঁদেনি মোদি সরকার ও গদি মিডিয়া। এখন তাদের কুম্ভীরাশ্রু কি গণঅভ্যুত্থানে শহিদ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রতি মশকরা নয়? 

জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে ২৫ নভেম্বর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করা হয়। এর পর আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে, চিন্ময়কে প্রিজন ভ্যানে তুলে কারাগারে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। এ সময় তার অনুসারীরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ ও বিজিবি লাঠিপেটা এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে। সংঘর্ষের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা আদালতের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয় যে, সাইফুল ইসলাম চিন্ময়ের আইনজীবী হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু, এই দাবি সঠিক নয়। চিন্ময়ের আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা, সাইফুল ইসলাম নন।

এই অপপ্রচারের কারণ— ভারতের প্রিয় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আশীর্বাদপুষ্ট গদি মিডিয়া খুব হতাশ। তারা পারলে এখনই নামিয়ে দিতে চায় ড. ইউনূসের সরকারকে। কিন্তু, চাইলে তো কোনো দেশের সরকার নামিয়ে ফেলা যায় না। হতাশা আর ক্ষোভে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন তারা। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে তারা। মিথ্যা তথ্য দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বাস্তবতাবিবর্জিত প্রতিবেদন ও ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। অপসাংবাদিকতায় কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। এক্ষেত্রে যেন কয়েক ধাপ এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া। 

রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১২ আগস্ট থেকে গতকাল ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পাওয়া গেছে। ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক ৫টি গুজব প্রচার করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট অন্তত ৩টি করে গুজব প্রকাশ করেছে। রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ এবং আজ তাক অন্তত দুটি করে গুজব প্রচার করেছে। বাকি ৪১টি গণমাধ্যম অন্তত একটি করে গুজব প্রচার করেছে।

এসব গুজবের মধ্যে ছিল- শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে মানববন্ধন করার ভিডিওকে হিন্দু ব্যক্তির দাবিতে প্রচার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি, ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার ভুয়া দাবি, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী হিসেবে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়ার গুজব, বাংলাদেশে মুসলিমদের হামলায় মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের দাবিতে ভারতের প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিও প্রচার, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য, চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে জানিয়ে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ সতর্কতা জারির বিভ্রান্তিকর খবর।

সংবাদমাধ্যমগুলোর আরও একটি উদ্দেশ্য আছে— বিতর্কিত, চটকদার প্রতিবেদন ও ভিডিও কন্টেন্টের পাঠক ও দর্শক-শ্রোতা বেশি। বেশি ক্লিক মানেই বেশি উপার্জন। তাই, ক্লিকবেইট জার্নালিজমের জন্য এসব কন্টেন্ট অর্থপ্রসবা।

কলকতাভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা ও এবিপি আনন্দ এবং আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের শুক্রবারের (৬ ডিসেম্বর) কয়েকটি প্রতিবেদন, ভিডিও কন্টেন্ট এবং তাদের ফেসবুক পোস্ট ও ফটোকার্ডের নমুনা তুলে ধরলে পাঠক বুঝতে পারবেন, অপপ্রচারে কতটা মরিয়া তারা। 

এবিপি আনন্দ তাদের ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে লিখেছে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদীরা রাত্রিবেলা অত্যাচার করছে, চাকরি করলে ছাড়তে হবে, না হলে ধর্মান্তর করতে হবে’। ফেসবুকে আরও লিখেছে, ‘মহিলারা শাখা-সিঁদুর পরে বেরোতে পারছে না, হিন্দু বুঝে গেলে সমস্যা বাংলাদেশে’। অথচ, এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি বাংলাদেশে। 

লেখাটি শুরু করেছিলাম গোয়েবলসের তত্ত্ব দিয়ে। শেষও করতে চাই তার পরিণতি দেখিয়ে। গোয়েবলস বলেছিলেন, “একটি মিথ্যা বার বার বললে সত্যের মতো শোনায়।” কিন্তু, মিথ্যা তো মিথ্যাই। একসময় সত্য বের হয়ে আসে, ছাইচাপা আগুনের মতো। 

গোয়েবলসের বলা মিথ্যাগুলো সত্য হয়ে যায়নি শেষ পর্যন্ত। কিছুদিন পরে হলেও মানুষ সত্য জানতে পেরেছে এবং মিথ্যা বলার জন্য গোয়েবলসকে ঘৃণা করেছে। তিনি এখন ঘৃণিত ব্যক্তির প্রতিমূর্তি। আর যেজন্য মিথ্যা বলেছিলেন গোয়েবলস, সেই নাৎসি সরকারও টেকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন আত্মহত্যা করে বার বার মিথ্যা বলার প্রায়শ্চিত্ত করেন জোসেফ গোয়েবলস। 

ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিষয়ে মিথ্যা লিখলেই তা সত্য হয়ে যাবে না। কারণ, সত্য বলা মানুষ ও মিডিয়াও তো আছে; ভারতেও আছে, দুনিয়াজুড়েই আছে। আর পুরো পৃথিবী ভারতীয় মিডিয়ার চোখে বাংলাদেশকে দেখার জন্য চোখ বন্ধ করে বসে নেই। 

লেখক: সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।

ঢাকা/রাসেল


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়