বাজার থেকে উধাও বোতলজাত সয়াবিন তেল
রায়হান হোসেন || রাইজিংবিডি.কম
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অন্যতম সয়াবিন তেল। বাংলাদেশে রান্নার কাজে এ তেলই বেশি ব্যবহার করা হয়। বাজারে হঠাৎ এই ভোজ্যতেলের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বর্তমানে খুচরা বাজারে সয়াবিন তেলের এক ও দুই লিটারের বোতলের প্রায় ৯০ শতাংশ উধাও। কেউ যদি ভাগ্যগুণে পেয়েও যান, তাহলে তাকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছেন বিক্রেতারা। অন্যদিকে, বিক্রেতাদের দাবি, ডিলারদের কাছে অর্ডার দিয়ে চাহিদার অর্ধেকও পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার শুল্ক-কর কমালেও চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেলের আমদানি বাড়েনি। ফলে, কম দামে সয়াবিন তেল পেতে টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে বোতলজাত সয়াবিন তেলে সংকটের কারণ তুলে ধরা হলো:
রমজানকে সামনে রেখে দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা
সাধারণ ক্রেতারা মনে করছেন, আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল মজুত করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি চেষ্টা করছে।
রাজধানীর রায়েরবাজারে সাত থেকে আটটি দোকান ঘুরে দুই লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পেরেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাজ্জাদুল আলম। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমার জীবনে এরকম খারাপ পরিস্থিতিতে পড়িনি কখনো। এতগুলো দোকান খুঁজতে হয়েছে। শেষে রাজ্জাক মামার দোকানে পেলাম, তাও দাম বেশি নিয়েছে। কী আর করার আছে, খেতে হলে নিতে তো হবেই। যারা এই সংকট সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
রাজধানীর নিউমার্কেটের বনলতা কাঁচাবাজারেও একই অবস্থা। প্রায় সব দোকানে সয়াবিন তেল নেই। এক ও দুই লিটারের বোতল তো নেই, পাঁচ লিটার পেলে ক্রেতাদের বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে।
এই বাজারে কেনাকাটা করতে আসা গৃহিণী নিপুণ আক্তার রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমি বাধ্য হয়ে পাঁচ লিটার তেলের বোতল নিচ্ছি। সব সময় দুই লিটারের বোতল নিতাম। দোকানদার বলতেছে আরও কিছু নেওয়া জন্য। তেলের মূল্য লেখা ৮১৮ টাকা, আর আমার কাছ থেকে ৮৫০ টাকা নিয়েছে। সরকারকে বলব, দ্রুত নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসুন।”
ডিলাররা সরবরাহ কমিয়ে দিচ্ছেন
সয়াবিন তেলের সংকট বিষয়ে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ডিলাররা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। বাজারে যে চাহিদা, তার অর্ধেকও পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, ডিলাররা বলছেন, মিল মালিক বা কোম্পানিগুলোর তাদেরকে চাহিদামতো সয়াবিন তেল সরবরাহ করতে পারছে না।
টি কে গ্রুপের ডিলার মেসার্স শফিক ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী শফিকুজ্জামান লিটন বলেছেন, “বর্তমানে কোম্পানি চাহিদামতো তেল দিতে পারছে না। আগে দুই ট্রাক মাল আসলে, এখন আসছে এক ট্রাক। ফলে, আমরা ঠিকমতো সরবরাহ করতে পারছি না। এখানে আমাদের ভুল বুঝে লাভ নেই। কারণ, আমরা মাল পেলে রেখে দিই না।”
মেঘনা গ্রুপের ডিলার শাহনাজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মারুফ হাওলাদার বলেন, “কোম্পানি থেকে তেল পাচ্ছি না। দিনে চাহিদা ২০০ কার্টন, সেখানে এখন ১০০ কাটুনও সাপ্লাই পাচ্ছি না। তাহলে, আমরা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদেরকে কীভাবে দেব?”
শুল্ক-কর কমালেও সয়াবিন তেলের আমদানি বাড়েনি
সাধারণত শুল্ক–কর কমানো হলে আমদানি বাড়ে। কিন্তু, বর্তমানে উল্টো আমদানি কমে গেছে। সরকার ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দুই দফায় শুল্ক–কর কমিয়েছে। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক–কর নামিয়ে আনা হয়েছে ৫ শতাংশে। ফলে, প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ক–কর ১৭-১৮ টাকা থেকে কমে ৭ টাকায় নেমে এসেছে অর্থাৎ প্রতি কেজিতে শুল্ক–কর কমেছে ১০ থেকে ১১ টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার টন। সে হিসেবে আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। সয়াবিন তেল তৈরির কাঁচামাল সয়াবিন বীজ আমদানিও খুব বেশি বাড়েনি। এটি সোয়া ২ লাখ টন আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র ৯ হাজার টন বেশি।
বিশ্ববাজারে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম
শুল্ক-কর কমালেও সয়াবিন তেলের আমদানি না বাড়ার কারণ হিসেবে আমদানিকারকরা বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন।
বিশ্বব্যাংকের পণ্য মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে শিগগির ভোজ্যেতেলের দাম কমার সম্ভাবনা কম। তাদের গত ৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত পণ্যের মূল্য তালিকা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম গড়ে টনপ্রতি ৫০ থেকে ৯১ ডলার বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দাম ৫০ ডলার বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৫ ডলার। পাম তেলের দাম ৯১ ডলার বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ ডলার। দুই মাস আগেও পাম তেলের টনপ্রতি দর ছিল ১ হাজার ডলারের নিচে।
বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সরকার ১০ শতাংশ শুল্ক কমালেও উৎপাদন ব্যয় বেশি। এছাড়া, বর্তমান পরিস্থিতিতে লাভ হওয়ার নিশ্চয়তা না থাকায় ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ইতস্তত করছে।”
তিনি বলেন, “গত ৫ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশন আমাদের ডেকেছিল। আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে। আমরা এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বসব।”
আরেক ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার বলেন, “বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েই চলেছে। শুল্ক-কর না কমালে আগেই লিটারপ্রতি ১৩-১৪ টাকা দাম বাড়ত। আবার শুল্ক-কর যা কমেছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে বিশ্ববাজারে। বেশি দামে কিনলে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে কি না, এমন অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় আমদানি কমেছে। সরকার এখন ভোজ্যেতেলের দর যৌক্তিকভাবে সমন্বয় করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। তাতে আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ভোজ্যতেলের ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার বাড়তে পারে। রোজার আগেই পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল আমদানি হবে।”
বাধ্য হয়ে অনেকেই দাঁড়াচ্ছেন টিসিবির লাইনে
দোকানে সয়াবিন তেল না পেয়ে অনেকেই ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে তেল সংগ্রহ করছেন।
রাজধানীর জিগাতলায় টিসিবির ট্রাকের সামনে আগের তুলনায় ক্রেতাদের বেশি ভিড় দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেছেন, “বাজারে ১ লিটার ও ২ লিটার তেলের বোতল পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে এখানে দাঁড়িয়েছি।”
কাকলি আক্তার নামের এক গৃহিণী বলেন, “এখানে আগে এত লম্বা লাইন ছিল না। কয়েকদিন ধরে বেশি মানুষ দেখছি। আমি পরিবারের প্রয়োজনীয় তেল পেঁয়াজ আলু টিসিবির ট্রাক থেকেই নিই। কিন্তু, এখন অনেকে তেলের জন্য এখানে ভিড় করছেন।”
বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেছেন, “মূল্য সংযোজন কর কমানোসহ নানা সুবিধা দেওয়ার পরও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো তেলের দাম না কমিয়ে উল্টো সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এবারের রমজানে পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর হতে পারে।”
হঠাৎ বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “রোজাকে ঘিরে কয়েক বছর ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট একটি পন্থা অবলম্বন করছে। রোজায় দাম না বাড়িয়ে রোজা শুরুর ৩ থেকে ৪ মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখছে। এতে রোজায় ক্রেতারা বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অতি মুনাফা লুফে নিচ্ছে সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট। এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে এদিকে নজর দিতে হবে।”
ঢাকা/রফিক