‘রাজনৈতিক উত্তেজনার’ মধ্যে বৈঠক, আলোচনায় দূরত্ব কমানোর চেষ্টা
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল এবং বিভিন্ন কারণে ‘কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি’ এবং উভয় দেশের ‘রাজনৈতিক উত্তেজনার’ মধ্যেই বৈঠকে বসতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত। উভয় দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) সোমবার (৯ ডিসেম্বর) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।
এফওসি বৈঠক একটি নিয়মিত ও স্বাভাবিক কূটনৈতিক কার্যক্রম হলেও বিভিন্ন কারণে এবারের বৈঠকটি অতিরিক্ত আগ্রহ তৈরি করেছে।
বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল দুদেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে সনাতন ধর্মীয় একজন নেতার গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত, সাথে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের অভিযোগও তুলেছে। আবার কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে হামলার ঘটনা নিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে পটপরিবর্তনের পর প্রথম বৈঠকে দুদেশ সম্পর্কের বরফ গলানো আর রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত দৃশ্যমান। ভারতের ত্রিপুরা, কলকাতা, মুম্বাইয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বাংলাদেশ মিশনে হামলা বা মিছিল নিয়ে যাওয়া, দিল্লি বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নেতিবাচক উক্তি; ওই দেশের মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদ করছে।
এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীমউদ্দিন এবং ভারতের পক্ষে বিক্রম মিসরি। দুজনই চীনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
বৈঠক ঘিরে অতিরিক্ত আগ্রহ যেসব কারণে
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘সংখ্যালঘু ইস্যুতে’ দুই দেশের সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি হয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি কিছু ঘটনাপ্রবাহ দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। তাতে এই বৈঠকে কী আলোচনা হয় এবং এখান থেকে নতুন কোন দিকে পরিস্থিতি মোড় নেয় কি না, তা নিয়ে আগ্রহ আছে মানুষের মনে।
আগস্টের পর থেকেই ভারত তাদের নিয়মিত ভিসা ইস্যু বন্ধ রেখেছে। ক্রমাগত দেশটির মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভুল তথ্যের সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর ছাপা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ ও তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার। এসব ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় রয়েছে ভারতের ৪৯টি গণমাধ্যম।
সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বিবৃতি ছাড়াও বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একজন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ করে’ গ্রেপ্তারের ঘটনার জের ধরে ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে হামলার ঘটনায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এ ঘটনায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
এরই মধ্যে ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন।
সব মিলিয়ে আপাত দৃষ্টিতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এই বৈঠক আনুষ্ঠানিকতা হলেও এর গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘‘আলোচনায় যাই থাকুক, সব ধরনের উসকানি নিরসন করে উত্তেজনা কমিয়ে এনে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এবারের এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।’’
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি উইংয়ের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আলম মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘এফওসিতে আমরা দুদেশের মধ্যে প্রধান প্রধান দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। বাণিজ্য, ভিসা সংযোগ, সীমান্ত হত্যা ও পানি বণ্টনসহ নির্ধারিত মূল বিষয়গুলো এ উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় প্রাধান্য পাবে।’’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল তার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘‘এফওসি বৈঠক হল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি কাঠামোবদ্ধ বিষয় এবং ভারতও এ বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে।’’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন রবিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশ ভারতের সাথে চলমান বাণিজ্য মন্দার একটি সমাধান আশা করছে, যা গত দুই থেকে তিন মাস ধরে অব্যাহত রয়েছে। আমরা আশা করি, এমন অচলাবস্থার দ্রুত সমাধান হবে।’’
এ সময় তিনি এফওসি বৈঠকের বিষয়ে বলেন, ‘‘এ সফরকালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সমস্যা এবং পারস্পরিক উদ্বেগের অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।’’
প্রতিবেশীদের মধ্যে খোলামেলা সংলাপের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আমরা যদি সমস্যার সমাধান করতে চাই, আমাদের প্রথমে তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।’’
বাংলাদেশ ও ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটি ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)’ নামে পরিচিত। এটি মূলত দুই দেশের সব বিষয় নিয়েই আলোচনার একটি ফোরাম।
এফওসি বৈঠকে নতুন ইস্যু যেমনি উঠে আসে, তেমনি আগের সিদ্ধান্তগুলো দুই দেশের তরফে কোনটি কতটা বাস্তবায়ন হল তা নিয়ে পর্যালোচনাও হয়ে থাকে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে কোন ক্ষেত্রে কী করা যায়, তেমন কিছুও আলোচনা হয় এই ফোরামে।
ঢাকা/এনএইচ