ভাইয়ের শোকে বাবা-মার মৃত্যু, দিশেহারা বোন
মনির হোসেন
বাবা থেকেও ছিলেন না থাকার মত। মা বড় করেছেন তিন ভাই-বোনকে। বড় ভাই মনির হোসেন পড়াশোনা শেষ করে সংসারের দায়িত্ব নেন।তার আয়ে চলত সংসার।
এরই মাঝে দেশে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।আন্দোলনে অংশ নেন মনির হোসেন।মা একমাত্র কন্যাকেও আন্দোলনে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেন।কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মনির হোসেন।
ছেলে হারানোর শোক সইতে না পেরে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা। মনিরকে হারিয়ে বাবাও পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।ছোট বোন সানজিদা আক্তার মীম বলেন, ‘‘ভাইয়ের শোকে তো মা-বাবা মারা গেছেন। তারা মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন।আমি এখন কী করব।’’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আল আজিজ ট্রাভেল এজেন্সির মনির হোসেনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৭২ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন মনিরের বোন সানজিদা আক্তার মীম।ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ এহসানুল হকের আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে কোনো মামলা বা জিডি আছে কিনা-তা তদন্ত করে ভাটারা থানা পুলিশকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন আদালত।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, জুনাইদ আহমেদ পলক, খসরু চৌধুরী, হাবিব হাসান, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
মা-বাবা আর ভাইকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সানজিদা আক্তার মীম
সানজিদা আক্তার মীম বলেন, ‘‘আব্বু ছোটবেলা আমাদের রেখে চলে যান। আমাদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। বড় ভাইয়ের সাথে কথা হত। আম্মুই আমাদের বড় করেছেন। বড় ভাই ছিলো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাকে হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ভাই তো মারা গেলো। আম্মু আগে থেকে একটু অসুস্থ ছিল। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।’’
মীম বলেন, ‘‘হুইল চেয়ারে করে তাকে গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠী নিয়ে যাই ভাইয়ের লাশসহ। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে আম্মুর অসুস্থতা বাড়তে থাকে। তাকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাই।কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি।শেষ পর্যন্ত আর বাঁচাতে পারলাম না।বাসায় থাকা অবস্থায় আম্মু প্রায়ই ভাইয়ের কথা বলতেন।আম্মু ভাবতেন ভাইয়া এই বুঝি বাসায় আসবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘বড় ভাই ও আমাকে আম্মু বলে ঘরে বসে থেকে কি করবে, আন্দোলনে যাও। সেখানে গিয়ে ওদের সাহায্য কর। দুই দিন আমার ভাই আন্দোলনে যায়। তৃতীয় দিনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল। এই শোকে আমার আব্বু-আম্মু দুজনই মারা গেলো।’’
মীম বলেন, ‘‘গত ১৯ জুলাই দুপুরে ভাইয়া গুলিবিদ্ধ হয়।৬টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরেরদিন ভোরে মারা যায়। কিন্তু তার লাশ দিচ্ছিল না।অনেক জায়গা যোগাযোগ করি। কেউ সাহায্য করেনি। কয়েকদিন ঘোরার পর লাশ পাই।’’
মীম বলেন, ‘‘ঢাকায় তিন চারটি কবরস্থানে যাই লাশ দাফনের জন্য।কিন্তু জানানো হয়, গুলিবদ্ধি কারো লাশ কবর দেওয়া যাবে না। পরে গ্রামে গিয়ে দাফন করি।’’
মীম বলেন, ‘‘বাবা ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসতো।ভাইয়ের শোকে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে বাড়ি নিয়ে আসা হয়।গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাবা মারা যান। ছেলে হারানোর পর স্বামীকেও হারানোর শোক। মা স্ট্রোক করেন।পরে তিনিও মারা যান।’’
তিনি বলেন, ‘‘মারা যাওয়ার তিন দিন আগে ভাইয়া নতুন বাসা ভাড়ার অ্যাডভান্স করে এসেছিলেন। কিন্তু নতুন বাসায় ওঠা হলো না।একটা ভাই আছে। সে থেকে না থাকার মত।এখন আমি কী করব।’’
মীমের বন্ধু জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘ওর ভাই ছিল সংসারের চাবিকাঠি। কিন্তু তাকে মেরে ফেলা হল। ওর তো একটা ফিউচার আছে। মামলাটা নিয়ে ব্যবসা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা করতে দেইনি। মামলার বিষয় নিয়ে ওকে অনেকে হুমকি দিচ্ছে। আমরা ওর নিরাপত্তা চাই।’’
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ‘কোটা আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই আন্দোলন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। তার বক্তব্যে প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকজন আন্দোলনকারীদের হুমকি দেন। তারা বলেন, আন্দোলন থেকে সরে যাও না হলে মা-বাবার কোলে ফিরে যেতে পারবে না। আন্দোলন ছাত্রদের দমনে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আনিসুল হকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের নির্দেশে ও হুকুমে অন্যান্য আসামিসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুলিশ সদস্যদের রোল পালন করে। আইনকে নিজের হাতে নিয়ে ১৫ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, গুম, খুন করা শুরু করে।১৮ জুলাই রাত থেকে সারা দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
মামলার অভিযোগে আরো বলা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা অন্যান্য এলাকার মত ভাটারা থানার বাঁশতলায় গত ১৯ জুলাই অবস্থান নেয়। সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ওই স্থানসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়। দুপুর ২টা থেকে ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করাকালে তাদের দমনে পুলিশ সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০০ থেকে ২০০ জন তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আসামিরা গুলি করতে থাকে।মনির হোসেনও গুলিবিদ্ধ হন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরেরদিন ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
ঢাকা/এসবি