ভাই হত্যার বিচার চেয়ে মীমের মামলা কোন পথে?
মনির হোসেন
আল আজিজ ট্রাভেল এজেন্সীর মনির হোসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে রাজধানীর ভাটারার বাঁশতলায় গুলিবিদ্ধ হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মনিরের মৃত্যুর পর মারা যান তাদের বাবা-মাও। কলেজ পড়ুয়া একমাত্র বোন সানজিদা আক্তার মীম বিচারের আশায় ঘুরছেন। আদালতে করেছেন মামলার আবেদন। সেই মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছেন হত্যার সঙ্গে জড়িত নন- এমন লোকজন।
গত ১৯ জুলাই দুপুরে ভাটারার বাঁশতলায় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মনির। পরের দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় ৫ ডিসেম্বর শেখ হাসিনাসহ ৭২ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন মীম।
ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ এহসানুল হকের আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে কোনো মামলা বা জিডি আছে কি না, তা তদন্ত করে ভাটারা থানা পুলিশকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন আদালত।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, জুনাইদ আহমেদ পলক, খসরু চৌধুরী, হাবিব হাসান, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
সানজিদা আক্তার মীম বলেন, “ভাইয়ের লাশটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়েছিল। অনেক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে গেছি। অনেকের বাসায় যাই, অনেককে ফোন করি। কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। অনেকে বলেন ঘুমিয়ে আছেন। তারা কি টানা তিন দিন ঘুমিয়ে ছিলেন?”
মীম বলেন, “ঢাকায় তিন চারটি কবরস্থানে যাই লাশ দাফনের জন্য। কিন্তু জানানো হয়, গুলিবদ্ধি কারো লাশ কবর দেওয়া যাবে না। পরে গ্রামে গিয়ে দাফন করি।”
সাহায্য না করায় ভাটারা থানা এলাকার কয়েকজন এবং লাশ দাফনে যারা বাধা দিয়েছেন তাদের মামলার আসামি করেছেন মীম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মীম বলেন, “আল্লাহর বান্দা মারা গেছে। অথচ তাকে দাফনে বাধা দিছে। আর অপরাধীর সাথে যারা থাকে সবাই দোষী।”
“গণহত্যার অর্ডারে অনেকে সায় দিয়েছে। আবার অনেকে প্রতিবাদ করেছে। সবাই যদি প্রতিবাদ করতো তাহলে কি এতগুলো মানুষ মারা যেতো? ওপর থেকে হত্যার অর্ডার আসছে। আর এরা বাস্তবায়ন করেছে। এরা বাস্তবায়ন না করলে এত মানুষ মারা যেত না।”
আসামিদের নাম জানতে চাইলে মীম বলেন, “নামগুলো আমি এখনই জানাতে চাচ্ছি না। আগে মামলা হোক। এখন জানালে হয়তো তারা সটকে পড়বে।”
মামলা নিয়ে একটি দল রাজনীতি করতে চেয়েছিল দাবি করে মীম বলেন, “মামলা ছিনিয়ে নিতে আমাকে ৫ লাখ টাকা অফার করেছিল। এলাকা থেকে ২৫০ জনের নামের লিস্ট দিয়েছিল আসামি করার জন্য। কিন্তু আমি রাজি হইনি। এ কারণে তাদের তোপের মুখে পড়ে যাই। হ্যারাজমেন্ট করা শুরু করছে আমাকে। নিজের বাসায় যেতে পারছি না।”
আপন কেউ না থাকায় মীমের পাশে দাঁড়িয়েছেন তার বন্ধুরা। মীমের বন্ধু জাহিদুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, “এ ধরনের ব্যক্তিদের আসামি করা হলে মামলার ভিত্তি আইনগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় সেই অপরাধের পরিকল্পনা বা বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাই মূল অপরাধী। পরবর্তীতে আলামত নষ্টসহ অন্য কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তাদের বিরুদ্ধে সেই ধরনের অভিযোগ আনা উচিত।”
“ভিকটিমের পরিবার অনেক সময় আবেগের বশবর্তী হয়ে যারা অপরাধের সাথে জড়িত না তাদের আসামি করতে পারে। এক্ষেত্রে আদালতের উচিত, যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচাই করে মামলা আমলে গ্রহণ করা।”
রোববার বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) ইসির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বলেন, “গণমামলায় গণআসামি থাকবে না। যেসব বাদী মামলা বাণিজ্য করছেন, তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা হবে।”
মামলার অভিযোগে বলা হয়, কোটা আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই আন্দোলন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। তার বক্তব্যে প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকজন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুমকি দেন। তারা বলেন, আন্দোলন থেকে সরে যাও না হলে মা-বাবার কোলে ফিরে যেতে পারবে না। আন্দোলন ছাত্রদের দমনে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আনিসুল হকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের নির্দেশে ও হুকুমে অন্যান্য আসামিসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুলিশ সদস্যদের রোল পালন করে।
মামলায় বলা হয়েছে, আইনকে নিজের হাতে নিয়ে ১৫ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, গুম, খুন করা শুরু করে। ১৮ জুলাই রাত থেকে সারা দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সানজিদা আক্তার মীম
মামলার অভিযোগে আরো বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা অন্যান্য এলাকার মত ভাটারা থানার বাঁশতলায় গত ১৯ জুলাই অবস্থান নেয়। সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ওই স্থানসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়। দুপুর ২টা থেকে ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করাকালে তাদের দমনে পুলিশ সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০০ থেকে ২০০ জন তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
আসামিরা গুলি করতে থাকে।মনির হোসেনও গুলিবিদ্ধ হন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরেরদিন ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
ঢাকা/এসবি