ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

‘যে ছেলের গায়ে ফুলের টোকা দিইনি, তাকে ছুরি মেরে হত্যা করল!’

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৩, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৬:১৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
‘যে ছেলের গায়ে ফুলের টোকা দিইনি, তাকে ছুরি মেরে হত্যা করল!’

রাজধানীর আগারগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন ইমরান

বাদশার সঙ্গে ইমরানের বন্ধুত্ব বেশি দিনের ছিল না। এর মধ্যেই ইমরানের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নেন বাদশা। টাকা ফেরত চাইলে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় দুই বন্ধুর। টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে ইমরানকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাতে করেন বাদশা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইমরানের মৃত্যু হয়।

রাজধানীর আগারগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন ইমরান। গত ১৯ অক্টোবর রাতে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় বাদশাকে আসামি করে তেজগাঁও থানায় মামলা করেন ইমরানের বড় ভাই মিজান মিয়া। গ্রেপ্তার করা হয় বাদশাকে। বাদশা দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। মামলাটি তদন্ত করছে তেজগাঁও থানা পুলিশ। 

তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক আমীর হামজা বলেছেন,“আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।”

চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ইমরান ছিলেন সবার ছোট। বাবা-মায়ের সঙ্গে তেজগাঁও থানাধীন গ্রিন রোডের একটি বাসায় থাকতেন। বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত। ইমরানকে দেশের বাইরে পাঠাতে চেয়েছিল পরিবার। কিন্তু, তা আর হয়নি। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

ইমরানের মা নীলুফা আক্তার বলেছেন,“বাদশার সঙ্গে ইমরানের পরিচয় বেশি দিনের না। বাসায় আইত-যাইত। ওরে দেখে সুবিধার মনে হয়নি। এজন্য ওরে আগেই বলছি, তুই বাসায় আসবি না। আমরা যখন বাসায় থাকতাম না, তখন সে চলে আসত। আমার ছেলেও বাদশাকে বাসায় আসতে নিষেধ করেছে। ইমরানের কাছ থেকে বাদশা ৫০০ টাকা ধার নেয়। টাকা দেয় না। এটা নিয়ে ওদের মধ্যে অনেক কথা কাটাকাটি হয়।”

তিনি বলেন, “১৯ অক্টোবর রাতে ইমরানকে ফোন করে ডাকে বাদশা। ছেলেকে বলেছি, বাবা, তুমি যাইয়ো না। আমরাই তোমারে টাকা দিয়ে দেব। কিন্তু, শুনল না। জিদ—টাকা নিছে, দেবে না কেন? ইমরানের হাত ধরছি। হাত থেকে ছুটে চলে যায় সে। অনেকক্ষণ হয়ে যায়, সে আর আসে না। ফোন দিছি। ২-৩ বার ফোন ধরে বলছে, আসতেছি। এরপর আবার ফোন দিই। কিন্তু, ফোন বন্ধ। পরে বাদশা ফোন দিয়ে জানায়, তারা হাসপাতালে। সেখানে যাই।” 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নীলুফা আক্তার বলেন, “হাসপাতালে গিয়ে দেখি, ছেলেটা বিছানায় কাতরাচ্ছে। আমার বাবা ভাত খেতে চায়, পানি খেতে চায়। কিন্তু, খাওয়াতে পারলাম না। বাবাটাকে কখনো শাসন করতে হয়নি। যে ছেলের গায়ে কখনো ফুলের টোকা দিইনি, তাকে ছুরি মেরে হত্যা করল! আমার বুক খালি করল। কতদিন হলো, ওর মুখে মা ডাক শুনি না। আমার ছেলেটা আর নাই। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। বাদশা যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি করতে না পারে। বাদশার কঠিন শাস্তি চাই।”

ইমরানের বাবা আলী হোসেন বেপারী বলেন, “বাদশার সাথে ইমরানের বন্ধুত্ব বেশি দিনের না। কলেজের বন্ধুদের মাধ্যমে পরিচয়। বাদশা ইমরানের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নেয়। কিন্তু, সেই টাকা আর দেয় না। ১৯ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে বাদশা ইমরানকে ফোন দিয়ে বলে, আয়, টাকা দেব। ইমরান বাসা থেকে বরে হয়ে যায়। সেখানে গিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। ইমরানের আরও চার বন্ধু সেখানে ছিল। হঠাৎ বাদশা ইমরানকে ছুরি মারে। কিন্তু, কেউ আটকায়নি।”

তিনি বলেন, “পরে বাদশা আমাদের বাসায় ফোন দেয়। বলে, ইমরান অসুস্থ। ঢাকা মেডিকেলে আছে। ও ছাদ থেকে লাফ দিছে। দুইটা রড ঢুকে গেছে। পরে আমরা হাসপাতালে যাই। আমাদের দেখে বাদশা সটকে পড়ে। ইমরানের রক্ত লাগবে। রক্ত দেওয়া হয়। পরদিন অপারেশন করা হবে। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। তবে, ছেলেটা আর ফেরত আসে নাই।”

আলী হোসেন বলেন, “ওর বন্ধুরা যদি এগিয়ে আসত। ঘটনাস্থল থেকে কয়েক গজ দূরে নাইটগার্ড ডিউটি করছিল। সে যদি এগিয়ে যেত অথবা গেটটা খুলে দিত, তাহলে হয়ত ছেলেটাকে বাঁচানো যেত। আমি অসুস্থ মানুষ। ক্যান্সারের রোগী। ভাবছিলাম, ছেলেটাকে বিদেশে পাঠাব। কিন্তু, হলো না। ছেলের হত্যাকারীর বিচার চাই।”

মামলার বাদী মিজান মিয়া বলেন, “ইমরানকে যখন ছুরি মারে, সেখানে আরও ৪-৫ জন ছিল। তারা চেয়ে চেয়ে দেখছে। তারা বাঁচানোর চেষ্টা করলে হয়ত ইমরান বাঁচত। এ কাজ (হত্যা) একা সম্ভব না। হত্যাকারীদের বিচার চাই।”

বাদশার আইনজীবী ইসমাইল হোসেন বলেছেন, “কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ইমরান বাদশাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে। বাদশা ছুরিটা ছিনিয়ে নিয়ে ইমরানকে আঘাত করে। রাগের বশবর্তী হয়ে আঘাত করে। হত্যার উদ্দেশ্য তার ছিল না। বাদশাই কিন্তু তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।”

ইমরান হত্যা মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ইমরানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকায় প্রতিদিনের মতো বাদশা তাকে ডেকে নেয়। ১৯ অক্টোবর রাতে তেজগাঁও থানাধীন কাজীপাড়া গার্ডেন রোডে বাদশার সঙ্গে ইমরানের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে বাদশা পিছন দিক থেকে ইমরানকে ছুরিকাঘাত করেন। ইমরান চিৎকার করেন। কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইমরান মারা যান।  

ঢাকা/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়