ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

‘আমরা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না!’

মনিরুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৩:১৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
‘আমরা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না!’

১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় কী হয়েছিল, ওই মুহূর্তে সে খবর আমাদের কাছে ছিল না। আমি বাঞ্ছারামপুর, হোমনা এবং নবীনগরের আংশিক দায়িত্বে ছিলাম। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মোট পাঁচটি ক্যাম্প করেছিলাম। প্রধান ক্যাম্প ছিল বাড়ি-দড়িকান্দিতে। পরিস্থিতি বুঝে পাঁচ-ছয়দিন হয়তো রামকৃষ্ণপুর থাকতাম, এরপর পাঁচ-ছয়দিন নবীনগর থাকতাম। আমার দলে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ১১জন ছিলেন। আগস্ট মাসে স্থানীয় প্রায় সাড়ে তিনশ মুক্তিযোদ্ধাকে এলাকাতেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। এতে দলের সদস্য, শক্তি ও সমর্থ আরও বৃদ্ধি পায়। এর বাইরে গ্রামের ছয়জন ছিল, ওরা শুধু তথ্য আদান-প্রদান করতো।

নবীনগরে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ। ওই দিন আমি আমার গ্রুপ নিয়ে আলোচনায় বসলাম। গ্রুপের টুআইসিসহ দলের সবাইকে নিয়ে বসে করণীয় ঠিক করলাম।সিদ্ধান্ত হলো নবীনগর থানা অ্যাটাকে আমরা অংশগ্রহণ করবো।

আমার ক্যাম্প থেকে নবীনগর থানা ছিল ছয় মাইল দূরে। আমরা পায়ে হেঁটে অগ্রসর হলাম। নবীনগর গিয়ে আশপাশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সবাই মিলে একত্রে বসলাম। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো কীভাবে থানা অ্যাটাক করবো, বা যুদ্ধ পরিচালনা করবো। নবীনগর থানা পর্যন্ত যেতে হলে নবীনগর বাজার হয়ে যেতে হবে। নবীনগর বাজারে অনেক বাঙ্কার করে রেখেছিল পাক-আর্মিরা। ওরা বাঙ্কারে অবস্থান করেছিল। কিন্তু আমাদের আক্রমণের মুখে ওরা বাঙ্কার থেকে থানার দিকে পিছু হটে চলে যায়। ফলে বাঙ্কারগুলো ফাঁকা হয়ে পড়ে। আমরা ওদের বাঙ্কারে অবস্থান নিতে থাকলাম। ওরা তখন থানা বিল্ডিংয়ে  অবস্থান নিল। আমরা থানা বিল্ডিং ঘেরাও করে ফেললাম। কিন্তু আমাদের কাছে থানা বিল্ডিং ভাঙার মতো কোনো অস্ত্র বা গোলাবারুদ ছিল না। কিন্তু তারপরও থানা ঘেরাও করে ফেলেছিলাম। 

আরো পড়ুন:

১৫ ডিসেম্বর এক পর্যায়ে ওদের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এসে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। আমরা ওর  কোমরে দড়ি বেঁধে পুনরায় থানার ভেতরে পাঠালাম বাকিদের আত্মসমপর্ণের প্রস্তাব দিয়ে। প্রলোভন দেখালাম। কিন্তু ওরা সহজে রাজি হচ্ছিল না। ওরা উল্টো আমাদের জেনেভা আইন অনুযায়ী দুটি প্রস্তাব দিলো। এক ইন্ডিয়ান আর্মি আনতে হবে, না হলে বাংলাদেশ রেডিও থেকে তাদের নাম ঘোষণা করতে হবে।

আগরতলা গিয়ে রেডিওর মাধ্যমে ওদের নাম ঘোষণা করা ওই পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য কঠিন ছিল। সেসময় নবীনগর থেকে তিন-চার মাইল দূরত্বে ঢাকা-সিলেট অভিমুখে যৌথ বাহিনীর অবস্থান ছিল। আমরা তখন তাদের কাছে খবর পাঠালাম। 

১৮ তারিখ সকালবেলা যৌথবাহিনী ঘটনাস্থলে এলো। ওদের দেখে দুই হাত উঠিয়ে ১৬ জন পাক আর্মি থানা থেকে বের হয়ে এলো। থানার পাশে মাঠের মধ্যে পাকিস্তানের ১৬জন আর্মিকে বসিয়ে রাখল যৌথবাহিনী। এরপর চেয়ার-টেবিল আনা হলো। যৌথ বাহিনীর পক্ষে একজন ইন্ডিয়ান আর্মি চেয়ারে বসলো। দেখলাম পাক-আর্মিদের ভেতর থেকেও একজনকে চেয়ার দেওয়া হলো বসার জন্য। এটা যুদ্ধের নিয়ম। কিন্তু আমরা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না! আবার আমাদের কিছু করারও ছিল না। 

ইন্ডিয়ান আর্মি বললো, আমরা ১৬ জন পাক আর্মিকে নিয়ে যাচ্ছি। রাজাকারদের আমরা নেবো না। ওরা পাক আর্মিদের নিয়ে গেল। আমরা নবীনগর থানায় ঢুকে দেখি অন্তত এক থেকে সোয়াশ রাজাকার। শতাধিক নারীও ছিল। পাক আর্মিরা এই নারীদের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে নিয়ে এসে থানায় নির্যাতন চালিয়েছে। নারীদের প্রত্যেকে ছিল ভীত। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। বললাম, ভয়ের আর কিছু নেই।

রাজাকারদের এক সারিতে দাঁড় করালাম। আরেক সারিতে নারীদের দাঁড় করালাম। নারীদের সঙ্গে কথা বললাম, কারও বাড়ি ফরিদপুর, কারও বরিশাল, কারও ভোলা। তাদের বললাম, তোমাদের যাওয়ার পয়সাও আমি দিতে পারবো না, আমার কাছে পয়সা নাই। তবে তোমরা চলে যেতে পারো। থানার পাশ দিয়ে ডান দিকের পথ দেখিয়ে দিলাম। তখন তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা আমাদের ছিল না।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, এরিয়া কমান্ডার বাঞ্ছারামপুর, হোমনা এবং নবীনগর আংশিক 
অনুলিখন: স্বরলিপি

 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়